|
|
|
|
‘কী পাইনি’ বনাম অভিমান |
আসছে পুরভোট। ফিরছে রাজনীতির লড়াই। কিন্তু কেমন আছে দুর্গাপুর?
ওয়ার্ডে ঘুরে-ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। আজ ওয়ার্ড ১৯ ও ২০।
সুব্রত সীট |
রাস্তার পাশে বাতি বসেছে।
বিদ্যুৎ থাকলে মৃদু আলোয় তবু চোখে পড়ে ভাঙাচোরা রাস্তা। আর না থাকলেই, হোঁচট!
সিপিএম কাউন্সিলর অবশ্য দাবি করছেন, পিচ ও কংক্রিট মিলিয়ে এলাকার ৯০ শতাংশ রাস্তা পাকা হয়ে গিয়েছে। লাগানো হয়েছে ১০৫টি আলো। তবে ‘সামান্য সমস্যা’ যে রয়েছে, তা তিনি মেনে নিয়েছেন।
বেনাচিতির রামকৃষ্ণ পল্লি, জলখাবার গলি, সুভাষপল্লি, আমবাগান, ভিড়িঙ্গি গ্রাম ছাড়িয়ে জাতীয় সড়কের গা পর্যন্ত ছড়িয়ে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। শহরের অন্যতম ঘিঞ্জি এলাকা। শহুরে সমস্যার সঙ্গে গ্রাম্য সমস্যাও রয়েছে।
যেমন, আদি ভিড়িঙ্গি গ্রাম এলাকায় বেশ কয়েকটি পুরনো বড় পুকুর আছে। কচুরিপানা জমে মজে গিয়েছে প্রায় সবই। সেগুলি সংস্কার করে ব্যবহার্য করে তোলা গেলে মশা-পোকার উপদ্রবও কমে। কিন্তু কাউন্সিলর সমীর কর্মকারের সে দিকে কোনও নজর নেই, অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দা প্রণব বসুর। সুভাষপল্লির তপন ঘোষের আক্ষেপ, “সংস্কারের অভাবে রাস্তা বেহাল। হাঁটাচলা দায়। রাতে বিদ্যুৎ না থাকলে হোঁচট খেতে হয়।” তাঁদের আরও অভিযোগ, এলাকায় পানীয় জলের ব্যাপক সমস্যা। পাইপে সরু হয়ে জল আসে।
রামকৃষ্ণপল্লির বিপ্লব সাহা হতাশ, “পাড়ার রাস্তাঘাট মেরামত করা হয় না। নিকাশির হালও তথৈবচ।” আমবাগানে রাস্তা কাঁচা। গড়াইপাড়ায় রাস্তা বেহাল। সুভাষপল্লির নতুন গড়ে ওঠা এক অংশে নিকাশি কাঁচা। কাউন্সিলর জানান, আমবাগানে রাস্তার কাজের জন্য দরপত্র ডাকার কাজ হয়ে গিয়েছে। যে কোনও দিন কাজ শুরু হবে। তবে সুভাষপল্লির বেহাল নিকাশি বা গড়াইপাড়ার রাস্তা সংস্কারের কাজ কবে শুরু হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে তিনি কিছু বলতে পারেননি। স্থানীয় তৃণমূল নেতা নিমাই গড়াই-সহ বিরোধীরা একবাক্যে দাবি করছেন, গত পাঁচ বছরে কোনও উন্নয়নই হয়নি। তিনি জানান, এই সমস্ত কাজের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহু আগে। তবে সঠিক পরিকল্পনার অভাব, কোথাও বাসিন্দাদের আপত্তি ইত্যাদি নানান কারণে কাজ শুরু হতে বিলম্ব হয়েছে। কাউন্সিলর অবশ্য পাল্টা দাবি করেন, তিনটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খোলা হয়েছে। একটির জন্য গড়া হয়েছে পাকা বাড়ি। বিএসইউপি প্রকল্পে বস্তিবাসীদের জন্য ৯৫টি বাড়ি করা হয়েছে। তাঁর মতে, “রাস্তা বা নিকাশির সামান্য সমস্যা রয়েছে। তবে বাদ বাকি ভাল কাজ হয়েছে।” |
১৯ নম্বরে মজা পুকুর। |
২০ নম্বরে ভেঙে গিয়েছে নর্দমা। |
|
সম্প্রতি ইতিউতি কিছু ‘কাজ’ অবশ্য শুরু হয়েছে। “ভোট আসছে না? এখন তো একটু কাজ দেখাতেই হবে!” টিপ্পনী কাটছেন এলাকার বাসিন্দারা। তবে কাউন্সিলর অন্য ‘তত্ত্ব’ দিচ্ছেন। তাঁর দাবি, “বর্তমানে যে সব উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে তার সঙ্গে পুর নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। আমাদের দল এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। উন্নয়ন এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।”
কী রকম ‘নিরবচ্ছিন্ন’ তা অবশ্য ওয়ার্ডবাসী ভালই জানেন। যেমন জানেন পাশের ওয়ার্ড ২০ নম্বরের বাসিন্দারাও। গত বার এক মাত্র যে ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল সিপিএম। পাঁচ বছর পরে কিন্তু এখনও অনুন্নয়নের অভিযোগ উঠছেই।
ভিড়িঙ্গি চাষিপাড়া, অরবিন্দপল্লি, বিদ্যাসাগরপল্লি, শ্রীনগরপল্লি, সূর্য সেন নগর, ‘বি’ জোন বস্তি নিয়ে ছড়িয়ে থাকা এই ওয়ার্ডে কী কী কাজ হয়েছে? প্রায় ২০টি পিচরাস্তা, ১৫টি কংক্রিটের রাস্তা, বেশ কয়েকটি নিকাশি নালা, বিধায়ক কোটায় তিনটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও তিনটি প্রাথমিক স্কুলের ভবন নির্মাণ, মুক্তমঞ্চ, তিনটি কমিউনিটি শৌচাগার, রাস্তায় আলো ফিরিস্তি দিচ্ছেন কাউন্সিলর রুমা পাল। বরং এর পরেও ওয়ার্ডের মানুষ অনুন্নয়নের অভিযোগ তোলায় ঝরে পড়ে অভিমান “সামান্য না হওয়াটাই বড় হয়ে গেল!” ‘কী পাইনি তার হিসাব’ কিন্তু যখন-তখন দিচ্ছেন এলাকার মানুষ।
বিদ্যাসাগর পল্লির সুব্রতা দে-র ক্ষোভ, “বছর ঘুরে গেল নর্দমা ভেঙে গিয়েছে। রাস্তায় জল জমে যায়। কাউন্সিলর কোথায়?” আর এক বাসিন্দা স্বপ্না দাস বলেন, “৪০-৪৫ ঘর পিছু একটি করে জলের সংযোগ। দিনে দু’বার জল আসে, থাকে ১০-১৫ মিনিট। এই গ্রীষ্মে তাতে কি চলে?” ‘ডি’ ব্লকের গোপু সাহার অভিযোগ, নর্দমার উপরে কালভার্ট বানানো হয়েছে ফুট দুয়েক উঁচুতে। রাস্তা থেকে হেঁটে বা সাইকেলে উঠতে অসুবিধায় পড়তে হয়। ভিড়িঙ্গি চাষিপাড়ার উদয়কুমার মাহাতো, শিবাজি মাহাতোরা বিরক্ত, “রাস্তা বলতে কিছু নেই। মশা-মাছির উপদ্রব। পাইপে জল আসে নামে মাত্র।” তৃণমূল নেত্রী মুনমুন সরকারের অভিযোগ, “রাজমহল থেকে ট্রাঙ্ক রোড যাওয়ার পাশে বড় নর্দমার জল উপচে রাস্তায় ওঠে। বর্ষায় এক হাঁটু নোংরা জল ভেঙেই যাতায়াত করতে হয়।”
রুমাদেবীর বাড়তি অসুবিধা, ঘরের মানুষ পর হয়েছে। ২০০২ সালে এই ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী অরবিন্দ পাল তৃণমূলের তাপস ভট্টাচার্যকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে আসনটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় দল রুমাদেবীকে মনোনয়ন দেয়। প্রাক্তন কাউন্সিলর অরবিন্দবাবু এখন তৃণমূলের নেতা। ফলে বিপক্ষের আক্রমণও আগের চেয়ে তীব্র হয়েছে। গত বার কংগ্রেস এই ওয়ার্ড তৃণমূলকে ছেড়েছিল, তারা আবার তা ছেড়ে দেয় জোটসঙ্গী পিডিএস-কে। কিন্তু বোঝাপড়ার অভাবে শেষ পর্যন্ত বিরোধীরা প্রার্থী দিয়ে উঠতে পারেনি।
সে বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে বিজয় মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে রুমাদেবী বলেছিলেন, “এই জয় প্রমাণ করল, বিরোধীরা জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।”
এ বারও একই কথা বলতে পারবেন তো? |
নজরে নগর |
ওয়ার্ড ১৯ |
ওয়ার্ড ২০ |
• পুরনো পুকুর মজে গিয়েছে।
• পর্যাপ্ত পানীয় জল মেলে না।
• সংস্কারের অভাবে রাস্তা বেহাল। |
• বর্ষায় নর্দমা উপচে রাস্তায় জল আসে।
• পথঘাট সারানো হয়, অবস্থা করুণ।
• পানীয় জলের ব্যাপক সঙ্কট। |
ভোটের সঙ্গে কাজের কোনও সম্পর্ক নেই।
সমীর কর্মকার, সিপিএম কাউন্সিলর |
সামান্য কাজ বাকি, সেটাই বড় হয়ে গেল!
রুমা পাল, সিপিএম কাউন্সিলর |
ওয়ার্ডের বাসিন্দারা একেবারেই বঞ্চিত।
নিমাই গড়াই, তৃণমূল নেতা |
রাস্তায় বয় নর্দমার জল, উনি দেখেও দেখেন না?
মুনমুন সরকার, তৃণমূল নেত্রী |
|
ছবি: বিশ্বনাথ মশান। |
|
|
|
|
|