প্রবন্ধ ...
হাতে রইল ইতিহাস
হান্ড্রেড সিসি-র একটা বাইক ছিল। প্রথম চাকরি পাওয়ার পর স্কুল-শিক্ষিকা মায়ের উপহার। একুশের জীবনে উদ্দাম গতি। কলেজের আধ-খাওয়া প্রেমের জাবর কাটা। খবরের কাগজের চাকরিতে থিতু হওয়ার চেষ্টা। মাসপয়লায় মাইনেটা নিয়েই নিউ মার্কেটের শো-রুমের দিকে দ্রুত ধাবিত হওয়া। ছুটির দিনে রাজা-উজির নিধন। অফিস থেকে সন্ধে-সন্ধে কেটে পড়তে পারলে পাড়ার চায়ের দোকানে সেঁটে-যাওয়া গভীরতর সব রাত। কোনও কিছুই খুব সিরিয়াসলি নিই না। ভাবখানা, অনেক সময় পড়ে আছে তো! হবে’খন।
তখনই শুনলাম গানটা।
‘তোমাকে চাই’।
কোথায়, কী ভাবে শুনেছিলাম, মনে নেই। সম্ভবত কোনও বন্ধুর থেকে ধার-করা ক্যাসেটে। কিন্তু মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল! আর হৃদয় বলতে লাগল, ছিল কোথায় লাইনগুলো! শব্দগুলো! এত চেনা! অথচ এত অচেনা! এত বলিষ্ঠ! আবার এত পেলব! দিনে-রাতে, অফিসে-আড্ডায়, বাইকে, বাসের ফুটবোর্ডে ঝুলতে-ঝুলতে গানটা আমায় খেয়ে ফেলল। না কি আমিই গানটাকে গিলে নিলাম?
যাদবপুরের বিজ্ঞ বন্ধু (যাদবপুরের বন্ধুরা অবশ্য ‘বিজ্ঞ’ই হয়ে থাকে) বলল, “শুনিসনি আগে? আমরা তো বহু আগে শুনেছি। যাদবপুরের সোশ্যালেই তো প্রথম গানটা পাবলিকলি গাওয়া হয়েছিল। তার আগে ক্যান্টিনেও।”
সেই শুরু।
শুরু এক পাগলাটে ভাল লাগার। শুরু মোটরবাইকের পিলিয়নে অগ্রজ-অনুজ নির্বিশেষে সহকর্মীদের তুলে নিয়ে গিয়ে গানটা কিনে দেওয়ার। আশির দশকের মাঝামাঝি আবাসিক স্কুল থেকে পাশ করে বেরনোর পর জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল তদবধি অমিতাভ বচ্চনের সমস্ত সিনেমা দেখে ফেলা। নইলে বন্ধু-বৃত্তে নিজেকে ভারী ব্যাকডেটেড এবং অন্ত্যজ মনে হত। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে জাতীয় কর্তব্য বদলে গিয়ে দাঁড়াল লোককে ডেকে ডেকে গানটা শোনানো। সারা দিন বাড়িতে বাজত, অ্যাসাইনমেন্টে গেলে কানে-আঁটা ওয়াকম্যানে। রাতে গানটাকে জড়িয়ে ধরে শুতে যেতাম। ঘুম থেকে উঠতাম। আর দুনিয়া জুড়ে বাজতে থাকত ‘এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই’।
শুরু হল এক অনন্ত জিজ্ঞাসার।
কাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া? প্রেমিকা? শহর কলকাতা? এই চার দিক? কাকে চেয়ে লেখা, ‘তোমাকে চাই’।
বহু দিন জবাব খুঁজেছি। গানের স্রষ্টাকে প্রশ্নও করে বসেছি। ফিচেল হেসে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, “আপনার কী মনে হয়? ধরে নিন, আপনার যার কথা মনে হয়, গানটা তার কথাই বলছে।” শুনে পেশাদার আমি ভেবেছে, যাহ্! জবাবটা পাওয়া গেল না? হেঁয়ালি করল লোকটা? ভিতরের পাগলাটে আমি ভেবেছে, কী দরকার! আমি তো আমার মতো করে গানটাকে নিয়ে নিয়েছি। গাইছি ঘরোয়া আসরে। গানটার প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়ছে আ-শরীর। তীব্র গরমে সদ্য ধারাস্নান সেরে উঠলে যেমন ঝরে পড়তে থাকে শান্তির জলধারা।
আমরা, এক আপাত-উদভ্রান্ত, বাংলা আধুনিক গানে বীতশ্রদ্ধ, সলিল চৌধুরীর পর কাউকে খুঁজে না-পাওয়া প্রজন্ম বহু দিন পর একটা গানকে পরতে পরতে জড়িয়ে নিয়েছিলাম শরীর-মনে। একুশ-বাইশ যখন প্রেমিকার কথা ভেবেছে, তখন চল্লিশ হয়তো ভাবছে আগামীর কথা। পঞ্চাশ ভাবছে ফেলে-আসা জীবন। কী যায়-আসে?
যায়-আসেনি বাংলা গানেরও। কুড়ি বছর আগের যে যুবক পাগলপারা ভাল-লাগায় আক্রান্ত হয়েছিল একটা গানে, চল্লিশ-উত্তীর্ণ মধ্যবয়সে পৌঁছে সে যখন পিছু ফিরে চায়, মাঝখানের বছরগুলোয় সে প্রাণপণ হাতড়েও সেই গানের তুল্য কিছু পায় না। এখনও পায় না। ‘তোমাকে চাই’-এর সন্তানসন্ততি হিসেবে দাড়ি-গিটার-জিন্স সমন্বয়ে কয়েকজন গায়ক এসেছিলেন বটে। তাঁরা অকপটে বলেওছেন (এখনও বলেন) যে, ওই গানটা না-জন্মালে তাঁরা গান গাওয়ার কথা ভাবতে পারতেন না। তাঁদের গুণের কদর করেই বলছি, তাঁদের কোনও একটি গান আস্ত এক বাঙালি প্রজন্মকে বন্দি করে ফেলতে পারেনি, যে প্রজন্ম মনে করত, এখনও করে, যে, ও জিনিস বাংলা গানে কখনও হয়নি। হবেও না। এমনকী, লিখতে কিঞ্চিৎ কষ্টই হচ্ছে, সে গানের স্রষ্টাও আর করে উঠতে পারেননি। নইলে কুড়ি বছর পরেও তাঁর অ্যালবাম আটক থাকে সেই মাইলফলকে! সেই জাদুকরী দুটো শব্দে! নইলে কুড়ি বছর পরেও যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সির আন্দোলনের পোস্টারে লেখা থাকে ‘অধিকার বুঝে-নেওয়া প্রখর দাবিতে..’।
বাংলা গানের ভগীরথ লিখেছিলেন, ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে ভীষণ এক আত্মিক সঙ্কটের মধ্যে অবলম্বনহীন, নিরাশ্রয় অবস্থায় ছেলেমানুষের মতো ভালবাসা চাইছিলেন। ভিতরে ভিতরে নিঃসঙ্গ, ভগ্নস্বাস্থ্য এক যুবক নিস্তরঙ্গ, ম্যাড়মেড়ে নগরসমাজে মরিয়া হয়ে জীবন খুঁজে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় রত। সেই মরিয়া মন্থন ও ঘাত-প্রতিঘাত থেকে গর্ভাধান হয়েছিল বঙ্গজীবনে ‘কাল্ট’-এর পর্যায়ে চলে-যাওয়া গানের ‘এমনই এক মুহূর্তে এক দিন কাগজে হিজিবিজি লিখতে লিখতে বেরিয়ে এল চারটি লাইন। মনে হল যেন প্রেমের গান লিখছি। এত ভয়ঙ্কর ভাবে যাকে চাইছিলাম, সে এবার আমায় আর আমার গানটাকে দখল করে বসল। কবেকার কলকাতা শহরের পথে লেখার মুহূর্ত থেকে আমার স্পষ্ট মনে হল, গানটা আর ঠিক আমার হাতে নেই। ঝড়ের বেগে লিখে গিয়েছি শেষ পর্যন্ত।’
রেকর্ড সংস্থার রেওয়াজ পুজোর আগে রিলিজ-এর শিকেয় তুলে ‘তোমাকে চাই’ বাজারে এসেছিল এপ্রিলের ২৩ তারিখে, যে তারিখটা কুড়ি বছর পার করে ফিরে আসছে ক্যালেন্ডারে, আগামী কাল। কিন্তু আনকোরা গায়কের আনকোরা অ্যালবামকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেননি। ভুস করে ডুবে গিয়েছিল গানটা। যেমন গিয়েই থাকে! ঘটনাচক্রে, সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনের প্রধান সে বছর রিলিজ-হওয়া সমস্ত অ্যালবাম শুনতে শুরু করেন। আচম্বিতেই তাঁর নজরে আসে ‘তোমাকে চাই’। কানে আসার পর ৩৫ হাজার প্রিন্ট বাজারে ছাড়ার বরাত দিয়েছিলেন তিনি। গানের লেখক, সুরকার, স্রষ্টাকে বলেছিলেন, “আই উইল বি ডুয়িং আ সার্ভিস টু ইন্ডিয়ান মিউজিক!” বাকিটা ইতিহাস।
অথচ, বাংলা গানের সাধনার যে অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল ‘তোমাকে চাই’, যে গানের হাত ধরে সামগ্রিক উড়াল দিতে পারত বাংলা গান, তা আটকে রইল সেখানেই! ঝড়ের মতো এল। বলিষ্ঠ স্বরক্ষেপণ এবং সুরের জাদুতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু ফিরে এল না! বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি দিয়ে শুধু ‘তোমাকে-চাওয়া’ বাংলা গানের সাধক দশচক্রে ঘেঁটেঘুঁটে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন রাজনীতির স্রোতে। তার জনকের সঙ্গে অতলে ডুব দিল বাংলা গানের নতুন এক ধারা।
মাঝের বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে এক অপ্রাপ্তির বোধ হয় বইকী! মনে হয়, ‘তোমাকে চাই’ বড্ড একলা পথ চলল। ‘তোমাকে চাই’ উদ্যাপনের পুরাতনী প্রেম বয়ে আনল সেই অন্তঃসলিলা দীর্ঘশ্বাসটুকুও!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.