এমন এক এপ্রিলেই তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে ডাঙ্গেপন্থীদের ‘লাইনে’র প্রতিবাদ করে ৩১ জনকে নিয়ে দলীয় বৈঠক থেকে ওয়াক-আউট করেছিলেন এক যুবনেতা। ১৯৬৪ সালে সেই ঘটনার অল্প দিন পরেই তেনালি কনভেনশন এবং সিপিএমের জন্ম। সে দিনের সেই যুবনেতা এখন বৃদ্ধ। কিন্তু ৪৮টি বসন্ত পরেও তাঁর প্রতিবাদ অব্যাহত! অটুট তাঁর আলাদা চলার ‘ঐতিহ্য’ও!
ভি এস অচ্যুতানন্দনকে নিয়ে দলের অস্বস্তি তাই চলছেই! জীবনের উপান্তে তাঁর জন্য সিপিএমের পলিটব্যুরোর দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেরলে ধুন্ধুমার বেধেছে! দলীয় সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিতে শুরু করেছেন নিচু তলার কর্মীদের একাংশ। দলের সমর্থকেরা বিভিন্ন জেলা ‘উই ওয়ান্ট ভি এস’ পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছেন। যেমন হয়েছিল গত বছর বিধানসভা ভোটের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভি এসের নাম না-থাকার প্রতিবাদে। সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনও ‘প্রভাবশালী’ নেতার টিকিট না-পাওয়া ঘিরে প্রতিবাদের ঘটনা অভিনব নয়। কিন্তু সিপিএমের মতো সংগঠন-নির্ভর দলে উচ্চ কমিটিতে কোনও নেতার স্থান না-পাওয়ার জন্য নিচু তলায় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এমন ‘প্রতিক্রিয়া’ বিরল। |
সিপিএম পার্টি কংগ্রেস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কাসারগোড়ে ভিএসের সমর্থনে পোস্টার। ছবি: পিটিআই |
সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের অবশ্য আশা, ক্ষোভের পরিবেশ বেশি দিন স্থায়ী হবে না। স্বয়ং ভি এস কী করছেন? পলিটব্যুরোয় শেষ পর্যন্ত জায়গা ফিরে না-পেয়ে (১৯৮৫ সালে কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে প্রথম বার পলিটব্যুরোয় গিয়েছিলেন। ২০০৯ থেকে সাসপেন্ড। এ বারে একেবারেই বাদ) তিনি আরও বেশি করে চলতে শুরু করেছেন ‘নিজস্ব পথে’। পার্টি কংগ্রেস শেষের পর কোঝিকোড়ে দলীয় সমাবেশে যাননি। বরং তিরুঅনন্তপুরমে ফিরে গিয়ে পরে যোগ দিয়েছেন এমন এক মিছিলে, যেখানে তিনি না-গেলেই সিপিএম স্বস্তি পেত! একটি সিমেন্ট সংস্থার এক আধিকারিক খুন হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ওই মিছিলে ছিলেন বিজেপি-র শোভা সুরেন্দ্রন। ছিলেন মুসলিম লিগের নেতারাও। ভি এসের যুক্তি , বিরোধী দলনেতা হিসাবে তিনি ওই প্রতিবাদে ‘সহমর্মিতা’ জানাতে গিয়েছিলেন। দলীয় পরিচয়ে নয়। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা যা-ই হোক, ঘটনায় সিপিএম নেতৃত্বের ‘অস্বস্তি’ বেড়েছে!
পিনারাই বিজয়ন, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন এবং এম এ বেবি কেরল থেকে পলিটব্যুরোর তিন সদস্য আaপাতত প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন ভি এস-কে নিরস্ত করতে। কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাঁরা আপাতত ‘সফল’ হয়েছেন। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের সঙ্গে আলোচনা করে ভি এস প্রথমে ঠিক করেছিলেন, পাশের রাজ্য তামিলনাড়ুতে ওই পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানাতে যাবেন। কিন্তু সিপিএমের দলীয় অবস্থান মোটেও ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে নয়। প্রকাশ কারাটদের সঙ্গে কথা বলে বিজয়নেরা বুঝিয়েছেন ভি এস-কে এবং তিনি আপাতত রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। কেরলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “কুডানকুলাম নিয়ে রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার সময় ভি এস ছিলেন। নিরাপত্তা বিধির সঙ্গে আপস করে বাইরে থেকে পরমাণু চুল্লি আমদানির আমরা বিরুদ্ধে। কিন্তু কুডানকুলামে রুশ চুল্লি নিয়ে আসার বিষয়টি এর আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সব জেনে ওঁর (ভি এস) ওখানে যেতে চাওয়াই উচিত হয়নি।” ওই পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিদেশের আর্থিক মদত আসছে বলেও দলীয় নেতৃত্বের তরফে ভি এস-কে ‘বোঝানো’ হয়েছে।
দলের নিচু তলা অবশ্য নেতৃত্বের এসব যুক্তি শুনতে নারাজ। তাদের রাজনীতি অনেক বেশি ‘আবেগনির্ভর’। ভি এসের নিজের জেলা আলপ্পুঝায় অন্তত জনাপঁচিশ সদস্য ইস্তফা দিয়েছেন। পদত্যাগীদের মধ্যে সিটুর জেলা কমিটির সদস্য, ডিওয়াইএফআই নেতা, লোকাল কমিটির সম্পাদক-সহ স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আছেন। রাজ্যের এক তরুণ সাংসদের বক্তব্য, “ভি এস নেতৃত্বে ছিলেন বলেই গত বিধানসভা ভোটে সিপিএম অত ভাল লড়াই করেছিল। ওঁর জন্যই এখনও বিরোধী এলডিএফ শাসক ইউডিএফের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। কী যুক্তিতে শীর্ষ নেতারা তাঁর মতো অপরিহার্য নেতাকে পলিটব্যুরোয় নিলেন না, কে জানে!” কারাট-বিজয়নেরা অবশ্য সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরো গড়ার সময় যুক্তি দিয়েছেন, বয়স এবং শরীরের কথা ভেবেই ভি এস-কে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হচ্ছে। সীতারাম ইয়েচুরি ছাড়া বিগত পলিটব্যুরোর কেউ কেরলের অশীতিপর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াননি।
বয়সের ভারে ভি এস যে ন্যুব্জ নন, কেরলের জনতা বিলক্ষণ জানে। এবং জানে বলেই সমস্যা বাড়ছে! মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আইন-বহির্ভুত ভাবে টি কে সোমান নামে এক ব্যক্তিকে ভি এস খাস জমি পাইয়ে দিতে গিয়েছিলেন, এই অভিযোগে ভিজিল্যান্স ও দুর্নীতি দমন শাখা তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল কয়েক মাস আগে। এই সপ্তাহেই কোচির এক নিম্ন আদালত জানিয়ে দিয়েছে, চার্জশিট জমা পড়ার আগে ওই এফআইআর বাতিলের নির্দেশ দেওয়া যাবে না। এই ঘটনাকে ভি এসের বিরুদ্ধে প্রচারে হাতিয়ার করছে কংগ্রেস। কিন্তু তাঁর সমর্থকেরা মনে করছেন, ভি এসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ‘সাজানো’। বিরোধী দলনেতা আর যা-ই হোক, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ নন।
জটিলতা বাড়তে থাকলে তাঁরা কী করবেন? ২০০৬ এবং ২০১১-য় যেমন চাপে পড়ে তাঁকে বিধানসভার টিকিট দিতে হয়েছিল, এ বার পলিটব্যুরোর ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে? কেরল থেকে পলিটব্যুরোর এক সদস্যের বক্তব্য, “কিছু ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেটা সামলে নেওয়া যাবে।” পলিটব্যুরোয় তাঁরই এক সতীর্থ অবশ্য বলছেন, “ইতিহাসের দু’বার পুনরাবৃত্তি হয়। এক বার ট্র্যাজেডি এবং পরের বার প্রহসন হিসাবে! কার্ল মার্ক্সের এই কথাটাই ভি এস প্রমাণ করছেন!” |