উভয় সঙ্কটে সিপিএম। উদ্ধারের পথ খুঁজতে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রসঙ্গ মসজিদের ইমামদের মাসে আড়াই হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান কি সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন? নাকি বিরোধিতা? না নীরব থাকা? কার্যত পথ হাতড়াচ্ছেন সিপিএম নেতারা। কিন্তু আলিমুদ্দিনের নেতারা বুঝতে পারছেন, বেশি দিন চুপ থাকা সম্ভব নয়। সিপিএম কী ভাবছে, রাজ্যের বড় অংশের মানুষ তা জানতে চান। দলের অবস্থান ঠিক করতে রীতিমতো আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নামতে হয়েছে আলিমুদ্দিনকে। সে কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বুদ্ধবাবু। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের দায়িত্বে ছিলেন বুদ্ধবাবু। সুতরাং ইমামদের ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে রাজনৈতিক ভাবে সিপিএমের লাভ না ক্ষতি হবে, তা নিয়ে তিনি নিজেই কথা বলছেন বিভিন্ন নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে।
পঞ্চায়েত ভোটের এক বছরও দেরি নেই। রাজ্যের ৩০ হাজার ইমামকে মাসিক ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভোট-রাজনীতিতে ‘ইতিবাচক’ প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছে তৃণমূল। ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতার পাশাপাশি মন্দিরের পুরোহিতদের ভাতার দাবিকে সমর্থন করে হিন্দু ভোট একজোট করার চেষ্টা করছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে সিপিএমের করণীয় কী?
নেতাজি ইন্ডোরে ইমামদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ঘোষণার এক দিন পরেই কোঝিকোড়ে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস শুরু হয়। নেতারা কলকাতায় ফেরার পর শুক্রবার দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর প্রথম বৈঠকে প্রাথমিক ভাবে বিষয়টি ওঠে। ঠিক হয়, আপাতত দল কোনও প্রতিক্রিয়া জানাবে না। মমতার ঘোষণায় বাংলার সমাজজীবনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা দেখেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সংখ্যালঘু সাব-কমিটির অন্যতম সদস্য মহম্মদ সেলিম শনিবার বলেন, “আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। ইমামদের ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু তা এখনও কার্যকর হয়নি। এই ঘোষণার আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া আছে। সব দিক দেখেশুনেই সময়মতো যা বলার বলব।”
রাজ্যে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। এ ছাড়া, বর্ধমান, উত্তর দিনাজপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরে মুসলিম ভোটের উপরে নির্ভর করেই বহু এলাকায় পঞ্চায়েতে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। অধিকাংশ রাজনীতিক ও সমাজবিজ্ঞানীর মতে, মুসলিমরা কখনওই একটি গোষ্ঠী হিসাবে ভোট দেন না। কিন্তু তাঁরা এ কথাও মনে করেন, সামগ্রিক ভাবে মুসলিমদের ভোটদানের মধ্যে একটি ‘সাধারণ মনোভাব’ থাকে। বিগত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে সেই মনোভাব ছিল সিপিএম-বিরোধী। ইমামদের ভাতা দেওয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই মনোভাবই অটুট রাখতে চান মমতা।
মুসলিম-অধ্যুষিত জেলাগুলিতে মমতার ঘোষণায় সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে প্রভাব জেলা নেতাদের খতিয়ে দেখতে বলেছে আলিমুদ্দিন। প্রয়োজনে জেলা নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন বুদ্ধবাবু। সিপিএমের নেতারা প্রাথমিক ভাবে আলিমুদ্দিনকে জানিয়েছেন, ওই সিদ্ধান্তে ইমামরা খুশি হলেও মুসলিমদের একাংশের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, তা হলে কি এ বার মসজিদকেও ‘নিয়ন্ত্রণের’ চেষ্টা করবেন মমতা? শরিয়তি আইন অনুযায়ী মসজিদের ইমাম সরকারি টাকা নিতে পারেন না। সে প্রশ্নও জেগেছে কিছু মুসলিমের মনে। মমতা অবশ্য সে বিষয়ে ‘সতর্কতা’ রেখেই সরাসরি সরকারি টাকা না-দিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে ওই ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। মমতা বলেছিলেন, সরকার ওয়াকফ বোর্ডকে ওই ভাতার অর্থ দিয়ে দেবে। ওয়াকফ বোর্ড ইমামদের টাকা দেবে।
সিপিএমের একাংশের মতে, মমতার সিদ্ধান্তের ফলে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট সিপিএমের দিকে ঝুঁকবে। কিন্তু রাজ্য কমিটির অনেক নেতা আবার ওই অভিমতকে ‘অতি সরলীকরণ’ মনে করছেন। বুদ্ধবাবু নিজে কোনও মন্তব্যে নারাজ। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও এখনই কিছু বলতে চান না। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেন, “এখনই কথা বলার সময় আসেনি। তবে এটুকু বলতে পারি, মমতা যে ভাবে ঘোষণা করছেন, তার কোনও শেষ নেই। আজ ইমামদের ভাতা দেবেন বলছেন। এখন মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রিরা যদি ভাতা চান, তা হলে কী হবে?”
প্রসঙ্গত, ইমাম-ভাতা প্রত্যাখানের আর্জি জানিয়ে এ দিন টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতির সঙ্গে দেখা করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। বরকতিকে তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সরকার কোনও ধর্মের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ দেখাবে না। তা হলে এ রাজ্যে সরকার ৭০ হাজার ইমামের মধ্য থেকে ৩০ হাজারকে কীসের ভিত্তিতে বেছে নিচ্ছে? |