‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই
কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই’ (রজনীকান্ত সেন)
বাবুই পাখির বাসা নিঃসন্দেহে এক শিল্পকর্ম। কিন্তু সত্যিকারের কুঁড়েঘরে থেকে যদি কেউ শিল্পের বড়াই করতে পারে, তা হলে সে তো বাঙালি। কয়েক হাজার বছর ধরে বাঙালি যে কুঁড়েঘর বানিয়ে আসছে, তা অনেক দিন আগেই লোকাল থেকে গ্লোবাল হয়ে গিয়েছে!
বাংলার মাটিতে বাঙালি প্রথম কবে ঘরবাড়ি বানিয়ে থিতু হয়েছিল? পণ্ডিতেরা বিবাদ করেন লয়ে তারিখ সাল। তবে বর্ধমানের পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় খ্রিস্টজন্মের হাজার বছরেরও আগে বাঙালির শিকারজীবী থেকে কৃষিজীবী হওয়ার নজির মাটির তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গিয়েছে যে, নগর-সভ্যতা তৈরি হয়েছিল উত্তরের বাণগড় থেকে বর্ধমানের মঙ্গলকোট হয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ে। তবে প্রাচীরঘেরা নগর তো অভিজাতদের জন্য, সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ থাকতেন কুঁড়েঘরেই।
কেমন দেখতে ছিল সেই সব কুঁড়েঘর? এখানেও নিশ্চিত বলা কঠিন, কারণ মাটির তলা থেকে খোঁড়াখুঁড়ি করে আর যা-ই পাওয়া যাক না কেন, আস্ত কুঁড়েঘর তো আর পাওয়া যায়নি। তবে যা পাওয়া গিয়েছে তা-ও কম নয়। মাটির মেঝে, খুঁটি পোঁতার গর্ত (যে খুঁটির উপর দাঁড়ায় ঘরের চাল), এবং আরও কিছু খুঁটিনাটি উপকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে আজকের (কিংবা ঠিকঠাক বলতে গেলে বলা ভাল গত শতকের, কারণ খড়ের চাল দেওয়া ঘর এখন গ্রামবাংলা থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছে সে খড়ও নেই সে ঘরও নেই) সঙ্গে সে কালের কুঁড়েঘরের চেহারায় বিশেষ ফারাক ছিল না। মেঝেটা আয়তক্ষেত্রের মতো, চার দিকে চারটে মাটির দেওয়ালের উপর খড়ের চাল। সামনে পিছনে চালা নামলে দোচালা, আর চার দিকে নামলে চারচালা। সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে চারচালার উপরে আবার একটা চারচালা থাকতে পারে, তখন তাকে বলব আটচালা। দোচালার উপরিভাগের মতো প্রান্তও ধনুকের মতো বাঁকানো, আর এটাই বাংলার কুঁড়েঘরের আদিরূপ।
|
এই ভাবেই হাজার দুই বছর বাঙালি বেশ নিশ্চিন্তে কুঁড়েঘর বানিয়ে বসবাস করছিল। মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্ত পর্বের তুলনায় পাল আর সেন রাজাদের সময়টা চেনা যায় বেশি। মাঝে একটু মাৎস্যন্যায় হয়েছিল, তবে গোপালকে রাজা করে দেওয়ার পর গোল মিটে যায়। তেরো শতকের গোড়ায় কী হইতে কী হইল লক্ষ্মণসেন পলাইয়া গেলেন। নিজের নামেই রাজধানী গড়েছিলেন আজকের গৌড়ের কাছে লক্ষ্মণাবতীতে, অথচ বুড়ো বয়সে বসে রইলেন প্রায় অরক্ষিত নবদ্বীপে! বখতিয়ার খিলজি সত্যিই সতেরো জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে নবদ্বীপ জয় করেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে, কিন্তু ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের পর বাংলা যে চিরকালের মতো বদলে গেল তাতে সন্দেহ নেই। যুদ্ধে হারলে বিজেতার অধীন হতে হবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু বাঙালির ধাত অন্য রকম, তারা বদলে ফেলল বিজেতাকেও।
বাংলার মুসলিম শাসনকর্তারা এত দূরে বসে দিল্লির শাসন নিয়ে কমই মাথা ঘামাতেন। বিশেষ করে স্বাধীন সুলতানদের আমলের দুশো বছরে (১৩৩৮-১৫৩৮) তো কথাই নেই। আর এই সময়েই বাঙালির কুঁড়েঘর ঢুকে
|
রেখাচিত্রে বাংলার কুঁড়েঘর। |
পড়ল সুলতানি স্থাপত্যে। বাংলা তখন ধনজনযৌবনগর্বে গর্বিত। আসলে সুলতানরা বোধহয় চাইছিলেন দিল্লি তথা মেনস্ট্রিম সংস্কৃতির প্রতিস্পর্ধী বাঙালি আইডেন্টিটি তৈরি করতে, আর তাকেই তুলে ধরতে। মসজিদ কি সমাধিসৌধ বানাতে তাঁরা বাংলার চালাঘরকেই আদর্শ মানলেন, পোড়া ইটের স্থাপত্যেও চালটা বাঁকিয়ে দেওয়া হল। মালদহের পান্ডুয়ায় একলাখি সমাধিভবনে (পনেরো শতকের গোড়ায়) এমন বাঁকানো চাল প্রথম দেখা গেল বলে অনুমান করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বীরভূমের সিয়ান গ্রামে মখদুম শাহের দরগার প্রবেশপথে বাংলার ইসলামি শাসনপর্বের প্রথম শিলালিপিটি (১২২১ খ্রিঃ) গাঁথা আছে, সেই দরগাটিও বাঁকানো চালের, এবং সুপ্রাচীন। ষোলো শতকের শেষে বাংলা মোগল শাসনে আসার আগে পর্যন্ত তো বটেই, তার কিছু দিন পরেও ঢাকা কি রাজমহলের মতো শাসনকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের ইসলামি স্থাপত্যে বাঁকানো চাল দেখা যায়। ভারতের অন্য কোনও রাজ্যের ইসলামি স্থাপত্যেই এ রকম ভাবে স্থানীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়নি!
সুলতানি আমলের মসজিদ বা সমাধিসৌধে বাঁকানো চাল ছিল, ছাদ ঢাকতে গম্বুজের সঙ্গে চারচালার ব্যবহারও দেখা যায়। মোগল আমলে সমাধিতে সরাসরি দোচালা ঘরের অনুকৃতি একটাই আছে, গৌড়ে কদম রসুল চত্বরে তথাকথিত ফত খানের সমাধি। তবে মোগল আমলে মূল স্থাপত্য স্বাভাবিক ভাবেই দিল্লির পথে হাঁটলেও দোচালা ঘর কোথাও কোথাও তার অঙ্গাঙ্গি হয়ে উঠেছে। আসলে বারো ভুঁইঞাদের শায়েস্তা করতে বাংলায় এসে মোগলরা চালাঘরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। মির্জা নাথান-এর লেখা সমসাময়িক বিবরণী বাহারিস্তান ই গায়েবি-তে এর উল্লেখ আছে। পরে আগ্রা দুর্গ তৈরির সময় এরই অনুসরণে খোলা ছত্রী বানান শাহজাহান, যা পরিচিতি পায় বঙ্গালি ছত্রী নামে। লালকেল্লায় দিওয়ান ই খাস-এ সিংহাসন বসানোর বেদিটিও এই আদলেই তৈরি। মোগলদের প্রভাবে রাজপুতরা এর ব্যবহার ছড়িয়ে দেয় ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
মজার ব্যাপার হল, বাঙালি তেরো শতক পর্যন্ত মন্দির বানিয়েছে উত্তর ভারতীয় শৈলীর অনুসরণে। সুলতানি আমলে কিছুটা সুস্থিতি ফেরার পর বাঙালি হিন্দু যখন নতুন করে মন্দির তৈরি শুরু করল, তখন তার মনে হয়েছিল, আরে, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া দেখা হয় নাই হাতের কাছেই কেমন স্থাপত্য রয়েছে। কুটিরের ধাঁচে তৈরি বাঁকানো চালের ইসলামি স্থাপত্য দেখে কি না জানা নেই, এ বার পুরোপুরি কুঁড়েঘরের আদলে দোচালা, চারচালা, আটচালা মন্দির তৈরি শুরু হয়ে গেল। এত দিনে বাঙালি আত্মস্থ হল। ষোলো থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বাঙালি মন্দির বানাতে গিয়ে আর কোনও দিকে তাকায়নি, শেষ দিকে অবশ্য একটু সাহেবদের ছোঁওয়া লেগেছিল।
বাঙালি হিন্দুর মন্দিরে যখন সাহেবি কেতার হাওয়া লাগছে, সাহেবরা তত দিনে কিন্তু ‘বাংলো’য় মজেছেন। বাংলার যা আবহাওয়া, তাতে এ ধরনের বাড়িই তো সেরা। সাময়িক আবাস (ডাকবাংলো) কি আয়েসে থাকা সব কিছুর জন্যই বাংলো পেটেন্ট হয়ে গেল। শাহজাহানের থেকে কোম্পানি বাহাদুরের হাত তো আরও অনেক লম্বাতার ভাললাগা বাংলো ছড়িয়ে পড়ল শুধু ভারতের নানা প্রান্তে নয়, উপনিবেশের সর্বত্র, আর সেখান থেকে আস্তে আস্তে বাকি পৃথিবীতে। আজ তার চেহারা এক এক জায়গায় এক এক রকম, তবু মেজাজে কোথাও তা একই সুরে বাঁধা। সে মেজাজের উৎস তো এখানেই, সে এখানেই। হমিন অস্ত ও হমিন অস্ত ও হমিন অস্ত।
|