কলিকাতা নড়িয়াছে। চলিতে চলিতে। কবিবর মার্জনা করিবেন, পুরাতন কাব্যকণা ঈষৎ নবায়ন দাবি করিল, তাই সামান্য বিন্যাস বদল। পরিবর্তনের স্রোত চলিয়াছে। যেমন একটি বর্ষ গিয়া নববর্ষ আসিল। বঙ্গাব্দে নববর্ষ। তাহারই সূচনার পূর্বে, চৈত্রশেষের লগ্নে, একদিন একটি কম্পন আসিল। কম্পনের সূত্রে আতঙ্ক আসিল। তাহার সূত্রে গুজব আসিল। বঙ্গজনতা কেহ সানন্দে, কেহ আতঙ্কে সেই গুজবরাশি গলাঃধকরণ করিলেন। স্পষ্ট ধরা পড়িল, কত শত বাড়িতে বিচিত্ররূপী ফাটল। কত বহুতল চক্ষুর সম্মুখে হেলিয়া পড়িল। অজস্র লোক দাবি করিলেন, তাঁহারা নাকি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, বাড়ি হেলিতেছে। অতঃপর ‘দর্শন’ কাহাকে বলে, ‘প্রত্যক্ষ’ কী, ‘বাস্তব’-ই বা কী জিনিস, এমন সব বিষয় লইয়া দুই-চারিটি মহাসন্দর্ভের জন্ম হইতে পারে। পণ্ডিতেরা কিছু সুভাষিত বর্ষণ করিতে পারেন। জনপরিসরে দৃশ্য ও দ্রষ্টাকে লইয়া সুগম্ভীর আলোচনা জমিয়া উঠিতে পারে। বাঙালির গুজব-প্রীতিটি কমিবে কি? |
আতঙ্কিত জনতার প্রতি কৌতুকনিক্ষেপ এমন একটি প্রশ্নের অভীষ্ট নহে। ভূকম্পনের ফলে যাঁহাদের সত্যই কোনও না কোনও সংকট হইয়াছে, মানসিক ক্লেশ বা সম্পত্তির কোনও হানি ঘটিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি পূর্ণ সমবেদনা জ্ঞাপন এবং রীতিমাফিক কতর্ব্য ইত্যাদি পালন করা উচিত। সমস্যা একটিই। মনের বাঘ। এই শার্দূলটি বঙ্গজনের অতীব প্রিয়। যখন কিছু করিবার নাই, তখন মনোগহনে তাহার নিভৃত বাড়বৃদ্ধি হইতে থাকে। এমন নহে যে বনে কোনও বাঘ নাই। কখনও কখনও কিছু হুংকার তো সত্যই শুনা যায়। তৎক্ষণাৎ মনের বাঘটি অমিতবিক্রমে লাফাইয়া পড়ে। বনের বাঘ একসময় চলিয়া যায়। মনের বাঘ চিরস্থির। তাহার লীলাও বিচিত্র। বাস্তব ‘এক’ হইলেও সে অনায়াসে ‘একশত’ হইতে পারে। বাস্তব তাহাকে ছুঁইতে পারে না। যুক্তি তাহাকে নড়াইতে পারে না। সে-ই যন্ত্রী। মনুষ্যেরা যন্ত্র। সকলই তাহার ইচ্ছা। কী হইতে কী হইয়া যায়, মনের বাঘ দেখিতে পায়, চতুর্দিকে সর্বনাশ! অতঃপর, অনেক সময়ই, তেমন কিছু হয় না। তাই বলিয়া ব্যাঘ্রপ্রবর নড়িবার নহে। আবার একদিন তেমন কোনও একটি ঘটনা ঘটিয়া যায়। তখন দিগন্ত পর্যন্ত লাফ দিয়া, পুনরায় মুখব্যাদান করে সেই স্বনির্বাচিত ব্যাঘ্র! নববর্ষে কি সেই বাঘের গর্জন কিছু কমিবে? সম্ভাবনা কম। কারণ, বাঙালির চিরকালীন প্রিয় অভ্যাস সর্বনাশের প্রতীক্ষা। মনে করো, শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর! সেই প্রতীক্ষা যত নিবিড়, মনের বাঘের ততই পোয়াবারো! কে কত বড় ভয়ঙ্করের কল্পনা করিয়াছিল, কে কত বৃহৎ তাণ্ডব দেখিয়াছে, এই সবই সেই মনের বাঘের যোগ্য আবহ রচনা করে। আড্ডা হইতে টুইটার, আত্ম-প্রকাশের যাবতীয় মাধ্যমে একটি সুমিষ্ট এবং নিরাপদ দূরত্ব হইতে বঙ্গজনের ভীতি-বিলাস চলিতে থাকে। নূতন বঙ্গাব্দ এই ভয়ের মূলোচ্ছেদ করুক। শুনিয়া মনের বাঘ ঠোঁট চাটিল। মনজঙ্গলে একটি হাওয়া আসিল। গুজবের ন্যায় হাওয়া। আছে, নাকি নাই, বুঝা কঠিন! |