|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
সত্যিই কি নারী-আন্দোলনের সূত্রপাত? |
জন্মসার্ধশতবর্ষে বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর নতুন আলোকপাত হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। সমস্যা একটাই, এমন ঘটনাবহুল একটি জীবন সম্পর্কে জানা যায় অতি সামান্য। সূত্র যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে কাদম্বিনীকে বোঝার কাজটা অনেকটা গোটাকতক ঘুলঘুলি থেকে উঁকি দিয়ে ঘরের চেহারাটা আন্দাজ করার মতো। তবু লেখক-গবেষকরা যে সে চেষ্টা করেছেন, তা প্রমাণ করে যে কাদম্বিনী আজও আমাদের কৌতূহল উসকে দেন। প্রকাশিত হয়েছে চারটি বই, তার মধ্যে একটি ইংরেজি। মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডক্টরাল গবেষণার ফসল, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি: দি আর্কিটাইপাল উওম্যান অব নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল (দ্য উইমেন প্রেস, ৮৯৫.০০)। কাদম্বিনীকে তাঁর সমকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখক। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন, মহিলাদের শিক্ষা ও কাজের দুনিয়ায় পা রাখা, ধর্ম সংস্কারের তাগিদ, এই সবই সেই সময়কে আন্দোলিত করেছিল। কাদম্বিনী ছিলেন ব্রাহ্ম, মেয়েদের হস্টেলে থেকে ইংরেজি পাঠ নিয়েছেন, পেশাদার ডাক্তার - সবক’টি অভিঘাতের প্রতিমূর্তি তিনি। মৌসুমী তৎকালীন খবরের কাগজ, সরকারি বিজ্ঞপ্তি, চিঠিপত্র খুঁজেছেন তাঁকে বোঝার জন্য। কিছু কিছু তথ্য আর একটু আলোচনা দাবি করে। যেমন, আশির দশকে কাদম্বিনীকে কেন্দ্র করে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা নিয়ে অত ঝড় বইল, অথচ ১৮৭১ সালের সালতামামিতে কলকাতায় ২৯০ জন মহিলা কবিরাজ আর ২১৫ জন মহিলা হাকিমের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তা হলে কি পর্দা থেকে বেরোনর ব্যাপারটাই বেশি আপত্তির ছিল? নাকি মহিলাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে ইংরেজদের আপত্তিটার আত্মীকরণ করেছিল নবজাগরণের বাঙালি?
নারায়ণ দত্ত কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথকে নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন। তাঁর লেখাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রায় সব গবেষক। ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী (সূত্রধর, ৬০.০০) বইটি তিনি কিশোর-কিশোরীদের জন্য লিখেছেন। লেখার মধ্যে গল্প বলার ভঙ্গীটি থাকলেও, পাতায় পাতায় এত নাম-ঘটনা ঠাসা যে ছোটরা খেই হারাবে। মূল ঘটনাগুলিও বর্ণবিদ্বেষ, লিঙ্গবিদ্বেষের রাজনীতি ঘিরে, যা ঠিক শিশুপাঠ্য নয়। তবে কাদম্বিনীর একটি সংক্ষিপ্ত, সহজ জীবনী হিসেবে একাত্তর পাতার বইটি অবশ্যই ভাল, দরকারিও।
আর একটু বিশদ জীবন পাওয়া যায় কালজয়ী কাদম্বিনী ও তার কাল (ডলফিন, ১২০.০০) বইটিতে। তবে সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন, তাকে ‘তথ্য-সম্পাদনা’ বললেই ঠিক বলা হয়। নানা বই থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যখন তথ্য অমিল, তখন উপন্যাসের অংশই তুলে দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস অধিবেশনের ইতিহাসে কাদম্বিনী প্রথম মহিলা বক্তা হলেও, তাঁর বক্তৃতাকে ‘নারী আন্দোলন ইতিহাসের নব পর্বের আরম্ভ’ বলা চলে কি? ১৮৯০ সালে কাদম্বিনী বক্তৃতা দেন কংগ্রেসে, তার পরের বছর আসে ‘এজ অব কনসেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৯১’ যা মেয়েদের সঙ্গমে সম্মতির বৈধ বয়স ১০ বছর থেকে ১২ বছর করল। তাই নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় দেশে। আইনের বিরোধিতা করেন বালগঙ্গাধর তিলক, সপক্ষে বলেন পণ্ডিতা রমাবাই। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার আনন্দীবাই জোশীও ভারতীয়দের জীবনে ইংরেজের হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন। কিন্তু কাদম্বিনী কিছু বলেছিলেন কি? যদি না বলে থাকেন, তবে কংগ্রেস সভাপতিকে ধন্যবাদ-জ্ঞাপক তাঁর দু-চারটি কথাকে নারী আন্দোলনের সূত্রপাত বলা ভুল হবে। একটি জীবনের প্রসার ও সীমা, দুটি নির্দেশ করাই জীবনীকারের কাজ।
কাদম্বিনীর জীবনে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রভাব গভীর ও বিস্তৃত - একাধারে তাঁর শিক্ষক ও জীবনসঙ্গী দ্বারকানাথ নিজের অভিজ্ঞতা ও আদর্শের নিরিখে গড়ে তুলেছিলেন কাদম্বিনীকে। স্বেচ্ছায় সংসারের দায়িত্ব সামলেছিলেন, স্ত্রীর রোজগারে সংসার চালাতে সংকুচিত হননি। কাদম্বিনীকে বুঝতে গেলে দ্বারকানাথকে না বুঝলে চলে না, তাই বরুণ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবুদ্ধ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন পাঁচশো পাতার দায়বদ্ধ দাম্পত্য: কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ (ছাপাখানা)। এই বইটির বিশেষত্ব, বিদেশের পত্র-পত্রিকা, নথিপত্র থেকে কাদম্বিনীর চিকিৎসক-জীবন এবং দ্বারকানাথের সমাজ আন্দোলনের জীবন বিষয়ে নানা তথ্য আহরণ। অদেখা কিছু ছবিও পাওয়া যাবে। এই দম্পতি যে দেশে-বিদেশে মানুষকে তাঁদের প্রতি কৌতূহলী, শ্রদ্ধাশীল করেছিলেন, তার নিদর্শন পাওয়া যায় বইটিতে। |
|
|
|
|
|