|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ঘরের ভাষা আর বইয়ের ভাষা |
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় |
শিশুশিক্ষার ভূমিকা, অমর্ত্য সেন। গাঙচিল-প্রতীচী, ১৫০.০০ |
নাম শিশুশিক্ষার ভূমিকা হলেও এই বইটি কিন্তু শিশুশিক্ষার পাঠ্যবিষয় বা পদ্ধতি-প্রকরণ নিয়ে অমর্ত্য সেনের কোনও মৌলিক ভাবনার গ্রন্থন নয়। চারটি লেখার মধ্যে তিনটি লেখকের প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভূমিকা; আর প্রথম রচনাটি সাক্ষরতা এবং প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক গুরুত্ব বিষয়ে একটি চিন্তাশীল প্রবন্ধ, যা ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ইংরেজি পত্রিকায়। সব রচনাই মূলে ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল; এখানে পাওয়া যাচ্ছে তার বাংলা অনুবাদ।
উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়দের মেধা এবং বিদ্যাবুদ্ধি আজ সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। দেশের লোক তা নিয়ে গর্বিত; অথচ এই দেশেই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ পড়তে-লিখতে জানেন না। এই অদ্ভুত ‘বৈপরীত্য’ বা রহস্যের কারণ কী? ‘ফার্স্টবয়দের দেশ’ (নামটি চমৎকার) প্রবন্ধে অমর্ত্য সেন জানাচ্ছেন, পিছিয়ে-পড়া পরিবার থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের একটা মূলগত ঘাটতি থাকে। শিক্ষিত পরিবারে শিশুরা যে-সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়, সেই সুযোগ তারা পায়নি। সাংস্কৃতিক পুঁজি বা কালচারাল ক্যাপিটালের উত্তরাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। ফলে অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুদের তুলনায় তাদের পিছিয়ে থাকাটা এক রকম অনিবার্য। এই বৈষম্য অন্তর্ধৃত হয়ে আছে সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠনের ভেতরেই। এই ‘অবিচারের প্রশ্ন’টিই হল ‘গোড়ার প্রশ্ন’ (পৃ. ১৪-১৫)।
পিয়ের বরদু, কার্ল ম্যানহাইম বা বেসিল বার্নস্টাইনের রচনার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, এই বিষয়টি নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে। যাকে ঘাটতি বলে মনে হয়, তা আদৌ ঘাটতি কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। কারণ এক বিশেষ ধরনের পুঁজি না থাকলেও দরিদ্র শিশুদের আছে জগৎনিরীক্ষার এক অন্য দৃষ্টিকোণ তার মূল্যও কিছু কম নয়। অমর্ত্য সেন অত গভীরে না গিয়েও মূলগত বৈষম্য প্রসঙ্গে জন্মসূত্রে আহূত এই বঞ্চনার বিষয়টি যে ভাবে নিয়ে এসেছেন, তা খুবই তাৎপর্যময়। সেই সঙ্গে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিদেশে শিক্ষিত ভারতীয়দের যতই কদর থাক না কেন, পণ্য-রফতানিতে দেশ কিন্তু সেই সেকেলে অবস্থাতেই প্রায় রয়ে গেছে। সেই সব পণ্যই বেশি চালান যায়, ‘যেগুলিতে শিক্ষার খুব একটা প্রয়োজন হয় না’ (পৃ. ১৭)।
শিক্ষার সঙ্গে মানব-উন্নয়ন, অধিকারচেতনা, নারীদের স্বক্ষমতা অর্জন ইত্যাদির সম্পর্ক, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন, নিম্নমানের শিক্ষার ফলে দেশের সামগ্রিক ক্ষতি, সর্বজনীন শিক্ষার আবশ্যকতা প্রভৃতি বিষয়ে এরপর অনেকটা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত অমর্ত্য সেন এই কথাগুলি বহুদিন ধরেই বলে আসছেন। তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা প্রশ্নাতীত, যুক্তির দৃঢ়তা অনস্বীকার্য; তবে বিষয়টি ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত হয়ে উঠেছে। |
|
অন্য রচনাগুলির ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হল, অমর্ত্য সেন তাঁর অভিমতের উৎস হিসাবে বারবার প্রতীচী সমীক্ষার উল্লেখ করেছেন। এই ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার আগেই অন্যান্য সমীক্ষা থেকে, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যে সবই জানা ছিল সেই কথাটা তাঁকে জানাবার সুযোগ পাই না। দরিদ্ররাও তাঁদের সন্তানদের শিক্ষায় আগ্রহী প্রতীচী-সমীক্ষা থেকে এই কথা জেনে ‘দারুণ অভিজ্ঞতা’-য় অমর্ত্য সেন রোমাঞ্চিত (পৃ. ২৪, ৬০)। সবিনয়ে বলি, এই কথাটা জানতেন না বোধহয় শুধু একজন যিনি বামশাসনে দীর্ঘকাল বিদ্যালয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। শিক্ষক দিবসের ভাষণে মানুষকে সচেতন করতে হবে এই গম্ভীর বাণী তিনি প্রায়শই প্রদান করতেন। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয়শিক্ষা অবৈতনিক হলেও অভিভাবককে কিছু অর্থ ব্যয় করতেই হয় (পৃ. ২৫)। যাঁরা সন্তানদের সরকারি স্কুলেই পাঠিয়েছেন, তাঁদের মোটেই চমকিত করবে না প্রতীচী-র এই আবিষ্কার।
২০০৯ সালে লেখা দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে অমর্ত্য সেন দাবি করেছেন, বিগত সাত বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার ‘তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে’, ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতির হার বেড়েছে, শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপস্থিতির সমস্যা অনেকটাই কমেছে এবং মিড-ডে মিল প্রকল্পের ‘সুফল স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে’ (পৃ. ৪১-৪৩)। প্রতীচী-সমীক্ষার তথ্য পরিসংখ্যান দিয়েই তিনি তাঁর দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০৬ এবং ২০০৮-এর কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের সমীক্ষা এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সমীক্ষা থেকে অবশ্য অন্য চিত্র, অন্য রকম পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। যেমন, ২০০৬-এর কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল, এই রাজ্যে স্কুলছাড়ের হার সারা দেশের গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি (আ বা প. ৪-৯-২০০৬)।
২০০২ সালে প্রতীচীর প্রথম সমীক্ষায় পাঠক্রম, পাঠ্যবিষয়, শিক্ষণপদ্ধতি ইত্যাদি দিকগুলি গুরুত্ব পায়নি। ২০০৯ সালের ভূমিকায় কিন্তু অমর্ত্য সেন অত্যধিক প্রাইভেট টিউশন-নির্ভরতার সঙ্গে এই প্রশ্নগুলিকে যুক্ত করে ‘গুরুভার’ এবং ‘উচ্চাভিলাষী’ পাঠক্রমের সমালোচনা করেছেন এবং তার সংস্কারের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন (পৃ. ৪৫-৫০)। দলিত, আদিবাসী এবং নিম্নবর্গ মুসলমান শিশুদের প্রসঙ্গ এনে শ্রেণিগত বৈষম্যের দিকটিকেও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।
পাঠ্যবইয়ের ভাষাটাই যে অনেক শিশুর কাছে প্রায় বিদেশি, ঘরের ভাষার সঙ্গে স্কুলের ভাষার এই বিরাট ব্যবধান যে শিক্ষায় অনাগ্রহের একটা কারণ সেই বিষয়ে অবশ্য তিনি কিছু বলেনি। ক্লাসে ঘরের ভাষা বলে ফেললে মান্য ভাষা থেকে বিচ্যুতির অপরাধে একটি শিশু কী ভাবে অপমানিত হয় সেই অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, লেখার এই অংশটা পড়ে তাঁরা হতাশ হবেন। শিক্ষক-সংগঠনগুলির সহায়তার জন্য অমর্ত্য সেন তাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন (পৃ. ৩৮, ৪৬)। ক্লাসের মধ্যে শিক্ষকের আচরণের খবরটা কিন্তু সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সভা করে পাওয়া যায় না।
মধ্যাহ্ন আহারের সুফল নিয়ে অমর্ত্য সেন বারবার লিখেছেন। ওই প্রকল্প চালু করতে গিয়ে ২০০৪-৫ সালে জাতপাত আর ছোঁয়াছুঁয়ির মতো শতেক শতাব্দী-প্রাচীন সংস্কারটি কী রকম কুৎসিত ভাবে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল সেই বিষয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য নেই। ধরে নিচ্ছি, এই প্রকল্পের সুবাদে স্কুলে ভর্তি আর উপস্থিতির হার বেড়েছে; কিন্তু শিক্ষার গুণমান? প্রতীচী-র সমীক্ষা বলছে: তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে এখনও (২০০৮) ১৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়তে পারে না, ১৯ শতাংশ লিখতে পারে না, ২৬ শতাংশ প্রাথমিক পাটিগণিত জানে না। যারা জানে, সেই দক্ষতা তারা অর্জন করেছে গৃহশিক্ষকের সাহায্যে (পৃ. ৪৬-৪৭)। প্রাইভেট টিউশন-নির্ভরতার হার যে এই সময়কালে বেড়েছে, তা অমর্ত্য সেন-ও স্বীকার করেছেন (পৃ. ৪৪)। খিচুড়ি ছাড়া স্কুল তা হলে আর কী দেয়? অমর্ত্য সেন স্পষ্টত উদ্বিগ্ন; যদিও অনড় থেকে গিয়েছে সাফল্যের দাবিটি।
|
|
|
|
|
|