গ্রামে এক কাঠা জমির দাম ছিল ৪০ হাজার টাকা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দাম লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছে!
রাজারহাট-নিউটাউন এলাকায় ইদানীং জমি পাওয়াই মুশকিল। যে কারণে ছোট-বড় সংস্থাগুলির ইদানীং নজর পড়েছে বারাসতের কেমিয়া-খামারপাড়ার মতো আশপাশের এলাকাগুলিতে। জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তেই গড়ে উঠেছে ‘দালাল-রাজ’। গড়ে উঠছে ‘সিন্ডিকেট’। ‘কাঁচা টাকা’-র লোভে দালালির কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের সন্দেহ, জমির দালালি নিয়ে বিবাদের জেরেই মঙ্গলবার রাতে কেমিয়া-খামারপাড়ার নওপাড়ায় খুন হন তৃণমূল কর্মী বিনয় বিশ্বাস। তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মাকেও কুপিয়ে, গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। এক জন ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “তল্লাশি চলছে। এর বেশি কিছু বলা যাবে না।”
অভিযোগ, দুষ্কৃতী প্রভাস ঢালি ও তার সাঙ্গপাঙ্গোরাই জড়িত এই হত্যাকাণ্ডে। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “প্রভাস কুখ্যাত দুষ্কৃতী। তোলা চেয়েছিল বিনয়ের থেকে। না পেয়ে খুন করেছে।” প্রভাসের শাগরেদ, ধৃত সুদীপ বালাকে জেরা করে অবশ্য জমির দালালি নিয়ে দুষ্কৃতীদের ‘গোষ্ঠী-সংঘর্ষের’ নানা তথ্য উঠে আসছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। জমির দালালি, সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে খুনোখুনির যে ‘রাজনীতি’ দেখা গিয়েছে রাজারহাট-নিউটাউন চত্বরে, তার আঁচ-ই এখন ছড়াচ্ছে নওপাড়ার মতো একদা শান্ত গ্রামাঞ্চলেও। স্থানীয় বাসিন্দা তথা পঞ্চায়েতের উপপ্রধান স্মৃতিকণা অধিকারীর কথায়, “গ্রামে আগে কোনও দিন এ সব ঘটেনি। বছর খানেকের মধ্যে কেমন যেন বদলে যাচ্ছে পরিবেশ।”
জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর, বছর দু’য়েকের মধ্যে এই এলাকায় বেশ কিছু ছোট-বড় সংস্থা আবাসন ও কারখানার জন্য জমি কিনেছে। বারাসত ২ ব্লক অফিস থেকে নওপাড়ার উপর দিয়ে ৮ কিলোমিটার নতুন একটি রাস্তা মিশেছে দোলতলায় যশোহর রোডে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। এ সব কারণেই বাড়ছে জমির দাম। স্মৃতিকণা দেবী বলেন, “জমির দালালি শুরু হয়েছে। তা নিয়ে গণ্ডগোলও হচ্ছে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাস কয়েক আগে বাগুইআটির জ্যাংরার এক ব্যবসায়ীর কাছে একটি জমি বিক্রি করেছিলেন বিনয়। সেই একই জমি আবার অন্য এক ক্রেতাকে বিক্রি করে দেয় প্রভাস ও তার আত্মীয় গৌতম ঢালি। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, ঠিকঠাক দলিল-দস্তাবেজ ছাড়াই জমি বিক্রির ঘটনা ঘটছে। ভয় দেখিয়ে জমি বিক্রিতে ‘রাজি করানো’ হচ্ছে অনেককে। কুখ্যাত সমাজবিরোধী গৌর-লুইসরাও এক সময়ে এ ভাবেই রাজারহাট-নিউটাউনের বিস্তীর্ণ এলাকায় জমির ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। গ্রামের মানুষ জানালেন, বছর খানেক আগে নিতাই ঘোষ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে আড়াই বিঘা জমি ‘কম দামে’ কিনে তা বাইরের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করার পরিকল্পনা নেন নিহত বিনয়। জানতে পেরে স্থানীয় পঞ্চায়েত ও তৃণমূল নেতৃত্ব ওই জমি বর্গা করে কৃষকদের মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। সে সময়ে জমি কেনাবেচার কাজে বিনয়ের ‘পার্টনার’ ছিল তারই প্রতিবেশী গৌতম ঢালি। পুলিশের দাবি, টাকা-পয়সার বখরা নিয়ে ইদানীং গৌতমের সঙ্গে বিবাদ বাধে বিনয়ের। মাস কয়েক হল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে প্রভাস। বিনয়কে ‘ভয় দেখাতে’ প্রভাসের দিকে হাত বাড়ায় গৌতম। পুলিশ সূত্রের খবর, খুনের আসামি প্রভাস ইদানীং লম্বা চুল-দাড়ি কেটে ফেলে ‘হরিনামে’ মেতেছিল। কীর্তনের দলও খুলেছে। লোকে তাকে চেনে ‘পুরোহিত’ নামে।
তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, তলে তলে পুরনো মেজাজেই ফিরছিল প্রভাস। তাকে সঙ্গে নিয়ে বিনয়কে ক্রমশ ‘কোণঠাসা’ করছিল গৌতম। কয়েকটি জমির দালালিও হাতছাড়া হয় বিনয়ের। সে সব কারণে প্রভাসের ‘অতীত’ নিয়ে ইদানীং মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন বিনয়। পঞ্চায়েত ও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে সম্প্রতি প্রভাসের নামে অভিযোগও জানান। সেই ‘আক্রোশ’-ও বিনয়-হত্যার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে পুলিশ। |