শিক্ষা আইন বহাল সুপ্রিম কোর্টে |
বেসরকারি স্কুলেও দরিদ্রদের সংরক্ষণ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
শিক্ষার অধিকার আইনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বজায় রাখল সুপ্রিম কোর্ট। এর ফলে বৃহস্পতিবার থেকেই ওই আইনের আওতায় দেশের সমস্ত বেসরকারি স্কুলে ২৫ শতাংশ আসন গরিব পড়ুয়াদের জন্য সংরক্ষিত করা বাধ্যতামূলক হল।
সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে শিক্ষার অধিকার আইনের আওতায় এমনিতেই বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পূর্ণ অবৈতনিক করা হয়েছে। এ বার সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে আংশিক সাহায্যপ্রাপ্ত এবং সরকারি সাহায্য-রহিত বেসরকারি স্কুলগুলিতেও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। সরকারি স্কুলগুলিও স্বাভাবিক ভাবেই এই নীতি মেনে চলবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি সাহায্য না নেওয়া সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অবশ্য এর আওতায় পড়বে না। তাদের ক্ষেত্রে ওই আইন কার্যকর হবে না। প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক জানিয়েছে, মাদ্রাসা বা বৈদিক স্কুলগুলিকেও এই তালিকার বাইরে রাখা রয়েছে। কারণ, মন্ত্রকের পক্ষ থেকে সেগুলিকে প্রথাগত বিদ্যালয় হিসাবে গণ্য করা হয় না।
বছর দু’য়েক আগে শিক্ষায় অধিকার আইন কার্যকর হয় গোটা দেশে। ওই আইনেই বলা হয়েছিল, সরকারের কাছ থেকে সাহায্য না নেওয়া বেসরকারি স্কুলগুলিকেও ২৫ শতাংশ আসন আর্থিক দিক থেকে দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির শিশুদের জন্য সংরক্ষিত করতে হবে। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় একাধিক বেসরকারি স্কুল। তাদের বক্তব্য ছিল, মোট আসনের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত করা হলে তাদের কোষাগারে টান পড়বে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে অবশ্য বলা হয়েছিল প্রতিটি স্কুলের ক্ষেত্রে যে আর্থিক ঘাটতি হবে, তা মিটিয়ে দেবে কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “বর্তমানে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ছাত্র পিছু তিন হাজার টাকা বছরে খরচ হয়। মন্ত্রক সেই অনুপাতে বেসরকারি স্কুলগুলিকে টাকা মিটিয়ে দিতে রাজি ছিল।” সেই প্রস্তাব না মেনেই আদালতে গিয়েছিল বেসরকারি স্কুলগুলি। |
তা ছাড়া, স্কুলগুলির বক্তব্য ছিল, শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা ভাবে কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না বলে ওই স্কুলগুলির দাবি। বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় ‘সোসাইটি ফর আনএইডেড প্রাইভেট স্কুলস’, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কুলস ফোরাম’-সহ একাধিক বেসরকারি স্কুলের সংগঠন। সংগঠনগুলির আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, টি এম পাই মামলায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে যত দূর সম্ভব স্বশাসন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এই আইনে সেই স্বশাসনের উপরে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
এ দিন সব ক’টি মামলার যৌথ শুনানিতে বেসরকারি স্কুলগুলির আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি এস এইচ কপাডিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ জানায়, বেসরকারি স্কুলগুলিতেও গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
এই রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি অবশ্য একমত হতে পারেননি। প্রধান বিচারপতি কপাডিয়া এবং বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমার বেসরকারি স্কুলে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করার পক্ষে মত েদন। যদিও বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন সরকারের আর্থিক সহায়তার বাইরে থাকা স্কুলগুলিতে ২৫ শতাংশ আসনে ফি মকুবে আপত্তি জানান। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতেরই প্রতিফলন হয় এ দিনের রায়ে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে আজ স্বাগত জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিব্বল। তাঁর কথায়, “এই সিদ্ধান্তকে কারও জয়-পরাজয় হিসাবে দেখা উচিত নয়। বরং বলা ভাল, এর ফলে একটি বিতর্কের অবসান হল।”
সিব্বল যাই বলুন, অস্পষ্টতা পুরোপুরি কাটেনি বলে বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষের একাংশের দাবি। সরকারি সূত্রের খবর, সরকারি সাহায্য না-পাওয়া বেসরকারি স্কুলে সংরক্ষিত আসনের পড়ুয়াদের জন্য ভর্তুকি দেবে রাজ্য সরকার। কিন্তু স্কুলগুলির বক্তব্য, ভর্তুকির পরিমাণ ঠিক কতটা, বেসরকারি স্কুলগুলিতে পড়ার পূর্ণাঙ্গ খরচ তাতে মিটবে কি না, বা সেই ঘাটতি মেটাতে অন্য পড়ুয়াদের পড়ার খরচ আখেরে বাড়বে কি না এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি। তা ছাড়া শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, এই রায় এ দিন থেকেই কার্যকর হবে। অর্থাৎ যে স্কুলগুলিতে ছাত্রভর্তির প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই মিটে গিয়েছে, তা বৈধ বলেই গণ্য হবে। কিন্তু যে সব স্কুলে ভর্তি-প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি, তাদের কী করণীয়, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে।
তবে এ দিনের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেই ফের আবেদন জানানোর পরিকল্পনা করছে বেসরকারি স্কুলগুলির কয়েকটি সংগঠন। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ স্কুলস ফর দ্য ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট’-এর তরফে কলকাতার সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের অধ্যক্ষ নবারুণ দে বলেন, “রায়ের প্রতিলিপি হাতে পাওয়ার পরে আমরা ফের একটি আবেদন করব বলে ঠিক করেছি। সরকারি সাহায্য ছাড়া পরিচালিত বেসরকারি স্কুলগুলি যদি ২৫ শতাংশ আসনে ফি ছাড়া ছাত্র ভর্তি করে, তা হলে সংখ্যালঘু স্কুল কেন ছাড় পাবে?” |