সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের পর্বে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন যে বিশিষ্ট জনেরা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামলেন তাঁদেরই একাংশ। বৃহস্পতিবার দিনভর তেমনই দেখা গেল শহরের রাজপথে। মমতা অবশ্য এ দিন রাতে দুর্গাপুর রওনা হওয়ার আগে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি শুনিনি। আমার কাছে কোনও খবর নেই।” মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, তিনি বিষয়টি নিয়ে খুব ‘মাথা ঘামাচ্ছেন’ না। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “মানুষ জানেন, কারা ওখানে গোলমাল করছে। মানুষই তাদের জবাব দেবেন।”
সম্প্রতি ই এম বাইপাসের ধারে নোনাডাঙায় বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে রাজ্য প্রশাসন। উচ্ছেদের প্রতিবাদে মিছিল করার জন্য এ দিন দুপুরে হাজরা মোড়ে জমায়েত হয়েছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর এবং নকশালপন্থী সংগঠনের কর্মীরা। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই সেই জমায়েতে হামলা চালায় এক দল স্থানীয় যুবক। জমায়েতকারীদের অভিযোগ, ওই যুবকেরা তৃণমূল কর্মী। যদিও পুলিশকর্তাদের দাবি, কোনও হামলার ঘটনা ঘটেনি। বরং মিছিলকারীদের মধ্যে ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়।
রাজ্যের প্রধান শাসক দল এবং পুলিশ-প্রশাসনের সেই ভূমিকার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন বিশিষ্টদের একাংশ। বিকেলে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে প্রতিবাদ-সভা করেছেন সুনন্দ সান্যাল, ‘বিতর্কিত’ তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমন, নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, জয়া মিত্র, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ও সুচিত্রা ভট্টাচার্য আসতে পারেননি। তবে প্রতিবাদের ‘সমর্থনে’ প্রথম জন লিখিত এবং দ্বিতীয় জন মৌখিক ‘বার্তা’ পাঠিয়েছেন। বিশিষ্টদের মিলিত বক্তব্যের নির্যাস: সরকারে আসার অব্যবহিত পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে সেই অভিযোগগুলিই উঠতে শুরু করেছে, যেগুলি তিনি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন শাসক বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তুলতেন। |
এই পরিপ্রেক্ষিতেই এঁদের বক্তব্য, এত দ্রুত যে মমতা তাঁর ‘ভূমিকা’ বদলে নেবেন, তাঁরা বোঝেননি! কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেছেন, “প্রতিবাদের মিছিল রুদ্ধ করে প্রতিবাদ বন্ধ করা যায় না। সরকারকে এটা বুঝতে হবে।”
ওই ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মন্তব্য করেছেন, “যাঁরা পরিবর্তন চেয়েছিলেন, আক্রমণের হাত থেকে তাঁরাও এখন রেহাই পাচ্ছেন না! এই ঘটনা গণতন্ত্রের উপর আক্রমণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মুখ বন্ধ করতে বলছেন, মন্ত্রীদের কারও কারও মুখ পুলিশ দিয়ে বন্ধ রাখছেন! কিন্তু আক্রমণ শুধু আমাদের উপরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দলমত নির্বিশেষেই প্রতিবাদ করতে হবে।” ‘প্রতিবাদে’র প্রেক্ষাপট তৈরি হয় দুপুরে হাজরা মোড়ে। পুলিশ জানায়, বেলা ১২টা নাগাদ যতীন দাস পার্কের সামনে জড়ো হন বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যেরা। তাঁরা হাজরা মোড় থেকে গোপালনগর পর্যন্ত মিছিল শুরুর তোড়জোড় করার সময়েই তাঁদের আটকানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ এক দল যুবক হঠাৎই আন্দোলনকারীদের উপরে চড়াও হয়ে মারধর করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন পুলিশও ঘটনাস্থলে উপস্থিত। পুলিশ সূত্রের খবর, মিছিলে হামলার ঘটনা দেখে ছুটে গিয়ে মিছিলকারীদের আটকানো হয়।
কেন মিছিলকারীদের আটকানো হল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ জানায়, ‘বেআইনি’ জমায়েত হচ্ছিল বলেই তাঁদের হঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক জনকে আটক করা হয়। যদিও এপিডিআরের সভাপতি দেবপ্রসাদ রায়চৌধুরী বলেন, “মিছিল এবং জমায়েতের ব্যাপারে আমরা বুধবার কালীঘাট থানায় লিখিত ভাবে জানাই। এ দিন বলা হয়, ১৪৪ ধারা রয়েছে। আগে তা জানানো হয়নি কেন?”
ওই হামলায় তৃণমূলের জড়িত থাকার অভিযোগ সরকারি তরফে অস্বীকার করে পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “নোনাডাঙা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেক গোষ্ঠী।” এই ঘটনা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল, এমন ইঙ্গিতও করেন তিনি। নোনাডাঙায় সরকারি জমিতে সিপিএমের মদতেই বসতি তৈরি হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। মন্ত্রী কথায়, “মাওবাদীদের মধ্যে এখন অনেক ভাগাভাগি। কারা কাদের সমর্থন-বিরোধিতা করছে, কে জানে! পুলিশ থাকতে আমাদের দলের ছেলেরা কেন রাস্তায় নামবে?” সিঙ্গুর আন্দোলনে তৃণমূলের সঙ্গী সংগঠনকে এখন ‘মাওবাদীদের দোসর’ বলা হচ্ছে কেন? তা সত্যি হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? মদনবাবু বলেন, “খোঁজখবর চলছে। সরকার যথেষ্ট বিবেচনার পরিচয় দিচ্ছে। সুচিত্রা মাহাতোর মতো কট্টর মাওবাদী সুস্থ পথে ফিরেছেন। আশা করছি, মাওবাদী সমর্থকেরা সকলে ওই পথ ধরবেন।”
সরকারের বক্তব্যের পাল্টা সাংসদ সুমনের বক্তব্য, “এ ভাবেই সিঙ্গুরে উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কমিটি গড়েছিলেন। ইতিহাসের কী খেলা দেখুন! সে দিন মমতার দু’পাশে যে দু’জন বসেছিলেন, এক পাশে শ্রীযুক্ত সুনন্দ সান্যাল, আর অন্য পাশে এই অধম! আমরা আজ আবার রাস্তায়।” সুমন আরও বলেন, “যে অমিতাভ ভট্টাচার্য, এমকেপি-র ছেলেমেয়েদের গ্রেফতার করছেন, তাঁরা মমতার সুহৃদ! তাঁরা মমতার অনশন মঞ্চে বক্তৃতা করে মার খেয়েছেন। তাঁদের গ্রেফতার করলেন? এটা তো কৃতঘ্নতা!” কৌশিক বলেন, “গঠনমূলক সমালোচনাকে সরকার-বিরোধী চক্রান্ত বলা হচ্ছে! আমাদের সিপিএম বলা চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা নিজেদের পরিচয়ে কথা বলতে পারি না?” পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডও ওই ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক ঝোঁক’ বলে মন্তব্য করেছেন। |
বিশিষ্টদের প্রতি পাল্টা ‘বার্তা’ দিয়ে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আবার বলেছেন, “বিশিষ্ট জনদের কাছে আবেদন করছি, একটু দেখুন। একটু ভাবুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা আমাদের সরকার গরিব-বিরোধী নয়। পুনর্বাসন না-দিয়ে উচ্ছেদের পক্ষপাতী আমরাও নই। তবে নতুন করে দখল করতে দেওয়া যাবে না। ওই জমিতে গরিবদের জন্য সরকারই বাড়ি করে দিচ্ছে।” পুরমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “সরকারকে অপদস্থ করতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু মানুষ গণ্ডগোল করছেন। যাদের পিছনে কখনও সিপিএম, আবার কখনও মাওবাদীরা রয়েছে। এতে সাধারণ জনজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা শক্ত হাতে তার মোকাবিলা করব।” দিল্লিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসুও বলেন, মাওবাদীরা রাজনৈতিক শক্তি। যারা প্রতিক্রিয়াশীলদের সমর্থন করার ভূমিকা নেয়।”
প্রসঙ্গত, গত বুধবার রুবির মোড়ে পুলিশ নোনাডাঙায় উচ্ছেদ-বিরোধী মিছিলে লাঠি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ। পর দিন তা নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর সময় ৬৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতির নেত্রী দেবলীনা চক্রবর্তী-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয়। আদালত তাঁদের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছিল। এ দিন ফের ওই সাত জনকে আলিপুর আদালতে হাজির করা হয়। এরই মধ্যে এ দিনের হামলার ঘটনার নিন্দা করেছেন মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র। তিনি বলেন, “খুব খারাপ ঘটনা। যাঁরা গণতন্ত্র সম্প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেন, তাঁরাই গণতান্ত্রিক অধিকার সঙ্কোচন করছেন। মিছিল-মিটিং করার মতো সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছেন। মানুষ কি এ জন্যই সিপিএম-কে হটিয়ে এঁদের ক্ষমতায় এনেছেন?”
|