স্টেশনভরা চিৎকার শুনে প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়া ট্রেনটাকে ওঁরা যখন খেয়াল করলেন, তখন দেরি হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। সদ্য ট্রেন থেকে নেমে লাইন পেরোতে যাওয়া ওই মানুষগুলো তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। ছুটে আসা ট্রেনটাকে দেখে এক মা কোনও মতে ছোট মেয়েদু’টোকে তুলে দিলেন প্ল্যাটফর্মে। পরের মুহূর্তে নিজেই চলে গেলেন ট্রেনের তলায়। দুই মেয়ের মা নাসিরা বিবি-সহ পাঁচ জনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু শনিবার দেখল সাঁতরাগাছি স্টেশন। সামান্য সময় বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে রেললাইন পেরোতে যাওয়ার চরম মূল্য দিলেন তিন পুরুষ ও দুই মহিলা। |
টনক নড়েনি দুর্ঘটনার পরেও। শনিবার সাঁতরাগাছিতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী |
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই ছিল মস্ত ওভারব্রিজ। তবু চটজলদি স্টেশন থেকে বেরোতে হেঁটে রেললাইন পার হওয়াটাই দস্তুর। আর সাঁতরাগাছিতে তো কম সময়ে স্টেশনের বাইরে কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছতে ঝুঁকি নিয়ে এ ভাবে হরদম লাইন পেরোন যাত্রীরা। রেল পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন বেলা সওয়া ২টো নাগাদ সাঁতরাগাছি স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে ঢোকে ডাউন তিরুঅনন্তপুরম-শালিমার এক্সপ্রেস।
ওই ট্রেন থেকে নেমে এক দল যাত্রী ওভারব্রিজে না উঠে পাঁচ এবং ছ’নম্বর লাইন পেরিয়ে স্টেশনের বাইরে যাচ্ছিলেন। তখনই ডাউন পাঁচ নম্বর লাইন দিয়ে ঢুকছিল হাওড়ামুখী রাঁচি-হাওড়া ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। বেশির ভাগ যাত্রী তড়িঘড়ি প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়লেও নাসিরা-সহ পাঁচ জন উঠতে পারেননি। ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যান তাঁরা। |
সাঁতরাগাছি স্টেশনে রেললাইন থেকে সরানো হচ্ছে দেহ। —নিজস্ব চিত্র |
ডাউন তিরুঅনন্তপুরম-শালিমার এক্সপ্রেস ওই প্ল্যাটফর্মে এসে থামতেই মাঝের এবং শেষ দিকের কামরার যাত্রীরা দ্রুত স্টেশন থেকে বেরোতে পাশের লাইনে নেমে পড়েন। সেই লাইনেই ধাবমান হাওড়াগামী ট্রেনটিকে খেয়াল করেননি তাঁরা। বজবজের প্রমীলা দে এবং তাঁর স্বামীও কয়েক মুহূর্ত আগে একই ভাবে লাইন পেরিয়েছিলেন। প্রমীলাদেবী বলেন, “আমরা প্ল্যাটফর্মে ওঠার পরেই দেখি, পাঁচ নম্বর লাইনে ট্রেন ঢুকছে। চিৎকার করে বাকিদের তাড়াতাড়ি উঠতে বলছিলাম। কোনও লাভ হল না।” চোখের সামনে পাঁচ জনকে কাটা পড়তে দেখে থম মেরে গিয়েছেন ওই মহিলা। |
মৃতদের মধ্যে ২৮ বছরের নাসিরা ছাড়া আর মাত্র এক জনেরই পরিচয় রাত পর্যন্ত জানা গিয়েছে। তাঁর নাম ঝন্টু দে (৫৮)। বাড়ি বর্ধমানের মনমোহন দে রোডে। নাসিরার বাড়ি নদিয়ার হোগলবেড়িয়ায়। এ দিন সাঁতরাগাছি স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় দুই মেয়ে মামনি এবং মৌসুমিকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মেই বসে রয়েছেন নাসিরার স্বামী মুস্তফা খান। তিনি জানান, কর্মসূত্রে কেরলে থাকেন তাঁরা। ছুটিতে গ্রামে ফিরছিলেন। মুস্তফার কথায়, “ব্যাগপত্র নিয়ে আমি লাইন টপকে ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়েছিলাম। নাসিরা দুই মেয়েকে নিয়ে তখনও নীচে। শেষ মুহূর্তে মেয়ে দু’টোকে ঠেলে প্ল্যাটফর্মে উঠিয়ে নিজে চাকার তলায় চলে গেল।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাঁতরাগাছির চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজটি রয়েছে পূর্ব দিকে, অর্থাৎ হাওড়ার দিকে।
এ দিন দুপুরে চার নম্বরে প্ল্যাটফর্মে ডিউটি করছিলেন রেল সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ান নন্দলাল রাই। তাঁর কথায়, “প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম দিকে (মৌড়িগ্রামের দিকে) আমাদের কয়েক জন জওয়ান ডিউটি করছিলেন। ওঁরা অনেককে লাইন পারাপারের সময়ে আটকান। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে কেউ না থাকায় কয়েক জন যাত্রী লাইনে নেমে পড়েন।” ওভারব্রিজে না উঠে কেউ রেললাইন পেরোলে জরিমানাও করার কথা আরপিএফের। সে কথা মেনে নিয়ে শালিমারের আরপিএফ অ্যাসিস্ট্যান্ট কম্যান্ডান্ট অরুণবিকাশ চক্রবর্তী বলেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টা আরও ভাল ভাবে দেখার মতো আরপিএফ কর্মীর অভাব রয়েছে। এই স্টেশনে আরও জওয়ান মোতায়েন করা দরকার।”
তবে ওই তল্লাটের নিত্যযাত্রী থেকে স্টেশনের কর্মী, সকলেই বলছেন, খুব বেশি যাত্রী ওভারব্রিজ ব্যবহারই করেন না। বিশেষত, কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে ঝুঁকি নিয়েই লাইন পার হন তাঁরা। মাইকে ঘোষণা করা হলেও কেউ তা কানে তোলেন না। এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ডিআইজি (আরপিএফ) ডি বি কেশর। তিনি বলেন, “যাত্রী সুরক্ষায় প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি একটি ওভারব্রিজ করার জন্য রেলের কাছে আবেদন জানাব।” দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখপাত্র সৌমিত্র মজুমদার বলেন, “রেলমন্ত্রী মুকুল রায় ইতিমধ্যে মৃতদের পরিবারের জন্য দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন। স্টেশনে সতর্কতা মেনে চলার জন্যও রেলমন্ত্রী যাত্রীদের কাছে আবেদন করেছেন।” |