শাসক দলের ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের’ রক্তক্ষয়ী ছবি দক্ষিণ ২৪ পরগনায়।
শুক্রবার গভীর রাতে জানলা দিয়ে গুলি চালিয়ে ক্যানিং-২ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি মানিক পাইককে (৫৫) ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করে আততায়ীরা। নিহতের ছেলে মৃদুলবন্ধু পাইক পুলিশের কাছে তৃণমূলেরই ব্লক যুব সভাপতি হাসান মোল্লা-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানান। যদিও সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী তথা ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের
|
মানিক পাইক।
নিজস্ব চিত্র |
তৃণমূল বিধায়ক শ্যামল মণ্ডল এই খুনের পিছনে ‘দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ রয়েছে বলে মানেননি। তিনি সিপিএমের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলেছেন। সিপিএম অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জেলায় জেলায় দলের শীর্ষ নেতা, এমনকী, মন্ত্রীদের সামনেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারি, বিক্ষোভ অব্যাহত। সম্প্রতি এই ক্যানিংয়েই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ‘বিড়ম্বনা’য় পড়েন তৃণমূল সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী চৌধুরীমোহন জাটুয়া। ক্যানিংয়ের দু’টি ব্লকে দলীয় সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের একাংশের চড়-থাপ্পড়, লাঠির বাড়ি পড়ে মন্ত্রীর গাড়ির বনেটে, কাচে। একই কারণে গত রবিবার তেতে উঠেছিল হুগলির হরিপাল। পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহের গাড়ি ভাঙচুর হয়। তার আগে দুই গোষ্ঠীর ঝামেলায় বহরমপুরে পণ্ড হয় তৃণমূলের সভা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী। গত মাসের গোড়ায় আরামবাগে দলীয় সম্মেলনে গিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বরদাস্ত করা হবে না’ বলে ‘হুঁশিয়ারি’ দিলেও কাজ হয়নি। তবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে মানিকবাবুর স্তরের নেতাকে খুনের অভিযোগ সম্প্রতি ওঠেনি। ক্যানিংয়ের জীবনতলা থানার তাম্বুলদহ-২ পঞ্চায়েতের নাগরতলা গ্রামে বাড়ি ওই তৃণমূল নেতার। শুক্রবার রাতে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। পাশে স্ত্রী রুমাদেবী। অভ্যাসমতো রাস্তার ধারের জানলা খুলে রেখেছিলেন তাঁরা। |
রাত দেড়টা নাগাদ ওই ঘটনা। মানিকবাবুর চোয়ালে, কোমরে এবং পেটে তিনটি গুলি লাগে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি মারা যান।
শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে যান ডিআইজি (পিআর) অনিল কুমার-সহ জেলা পুলিশের কর্তারা।
রুমাদেবী অনিল কুমারের পা ধরে বলেন, “আপনি ন্যায় বিচার করুন। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিন।” পুলিশকে রুমাদেবী জানান, তিনি গুলির শব্দ পাননি। ঘরের পাশে বোমা ফাটার শব্দে ঘুম ভেঙে তিনি দেখেন, রক্তে ভিজেছে বিছানা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানিকবাবুর মৃত্যু হয়। অনিল কুমার বলেন, “অভিযুক্তেরা পলাতক। তাদের খোঁজ চলছে। দুষ্কৃতীদের দ্রুত ধরতে পারব বলে আশা করছি।”
হাসান মোল্লা ছাড়া অভিযুক্ত বাকি ৬ জন হলেন হাসানের ভাই নজরুল মোল্লা, আশরফ মোল্লা, আজগর হালদার, মুজিবর হালদার, মজিদ শেখ এবং দীপঙ্কর নস্কর। ৭ জনই ক্যানিং-১ ব্লকের দলীয় সভাপতি শৈবাল লাহিড়ির অনুগামী হিসেবে পরিচিত। যে শৈবাল লাহিড়ির গোষ্ঠীর সঙ্গে মানিকবাবুর গোষ্ঠীর ‘বিরোধ’ চলছে কয়েকমাস ধরে। ইতিমধ্যে মউখালিতে মেছোভেড়ির দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ এবং বোমা-গুলির লড়াই হয়েছে। নিহতের ছেলে মৃদুলবন্ধুর অভিযোগ, “দলের লোকেরাই বাবাকে খুন করল।” মানিক-গোষ্ঠীর নেতা সওকৎ মোল্লাও বলেন, “মানিকবাবু আমাকেও কয়েক বার বলেছেন, ‘তুই সাবধানে থাকিস। আমাকে আর তোকে খুনের চক্রান্ত করছে বিরুদ্ধ গোষ্ঠী’। ওঁর সে আশঙ্কাই সত্যি হল।” শৈবালবাবু বা তাঁর অনুগামীদের এ দিন নাগরতলায় দেখা যায়নি। শৈবালবাবুর সঙ্গে বহু চেষ্টাতেও যোগাযোগ করা যায়নি।
এ দিন নিহতের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চৌধুরীমোহন জাটুয়া এবং সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, “কিছু দুষ্কৃতী এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশকে তাদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।’’ ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই বলেও তাঁর দাবি। শ্যামলবাবুর অভিযোগ, “মানিকবাবু এলাকায় দলকে চাঙ্গা করছেন দেখে সিপিএমের লোকজন মাওবাদীদের কায়দায় তাঁকে হত্যা করল।” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “দলের লোকজন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়।” সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেন, “আমি শুনেছি, ওই পরিবারের লোকেরা তৃণমূলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করেছে থানায়। এর মধ্যে সিপিএম এল কোথা থেকে?”
ঘটনায় ক্ষুব্ধ জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে যদি দলের এই অবস্থা হয়, তা হলে ভোটে আমাদের দুর্ভোগ ঠেকাবে কে?” |