এক দিকে ঢালাও ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি। অন্য দিকে, সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পের জন্যও জমি অধিগ্রহণ নয়। রাজ্যের জমি নীতির ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও এই দুই বিষয়ে অনড়। অথচ তাঁর সরকারের ভিতরেই বিষয় দু’টি নিয়ে উঠে এসেছে ভিন্ন মত। মহাকরণ সূত্রের খবর, যুক্তির দিক থেকে সেই মত এতটাই জোরালো যে, মুখ্যমন্ত্রী তা একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না। তাই বিধানসভার চলতি বাজেট অধিবেশনেও রাজ্যের জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ বিলটি আসছে না।
গত ২০ মে শপথের দিনই সন্ধ্যায় মহাকরণের রোটান্ডায় দাঁড়িয়ে বাছাই করা কয়েকটি বিষয় নিয়ে ঘোষণা করেন মমতা। সেই তালিকায় ছিল নতুন জমি নীতির কথাও। তার পর দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোমেন্দ্রনাথ বসুকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। তাঁরা দ্রুত সুপারিশ জমা দেন। সেই সুপারিশ নিয়ে মন্ত্রিসভার সাব-কমিটিতে আলোচনা এবং রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা অনুমোদনও করানো হয়। তার পরেও বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি আসেনি। যদিও অধিবেশন চলাকালীন প্রস্তাবিত বিলের ‘কপি’ এক সময় বিধায়কদের হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু পরে বিধানসভার স্পিকার জানিয়ে দেন, ভুল করে কয়েক জন বিধায়কের কাছে ‘কপি’ পৌঁছেছে। সেটি অধিবেশনে পেশ করা হবে না।
ধরে নেওয়া হয়েছিল, তা হলে বাজেট অধিবেশনে বিলটি আসবে। কিন্তু তা-ও হচ্ছে না। বিধানসভা সূত্রের খবর, এ বার অধিবেশন চলবে সোমবার, ২ এপ্রিল পর্যন্ত। নিয়ম মতো আট সপ্তাহ বাদে জুন মাসে দফতরওয়াড়ি বাজেট পেশ করার জন্য ফের অধিবেশন বসার কথা। এর অর্থ, সেই সময় বিলটি এলেও তত দিনে সরকারের বয়স এক বছর পেরিয়ে যাবে। তার পরেও বিল পাশ হয়ে আইনে পরিণত হতে আরও কয়েক মাসের ধাক্কা।
কেন এই অধিবেশনে আসছে না জমি বিল?
সরকারি তরফে তার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু মহাকরণের খবর, প্রস্তাবিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে ভিন্ন মত উঠে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী তার সঙ্গে সহমত হয়েছেন, এমন ইঙ্গিত এখনও নেই। তবে তা একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না তিনি। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই এ বারও মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা ভূমি সংস্কার দফতর বিধানসভার দু’সপ্তাহের অধিবেশনে বিল আনছে না।
নতুন বিলটিতে ক্ষতিপূরণের বহর কেমন?
সেখানে বলা হয়েছে
• অধিগ্রহণের সময় বাজারের দাম অনুযায়ী জমির দাম (গ্রামাঞ্চলে দ্বিগুণ) নির্ধারণ করা হবে
• ১০০% ‘সোলেসিয়াম’।
পাশাপাশি
• জমিদাতা প্রতিটি পরিবারের এক জনকে সরকারি চাকরি অথবা এককালীন অর্থ
• এক বছর ধরে মাসিক ভিত্তিতে টাকা
• অধিগৃহীত এলাকায় বাড়ি থাকলে তার জন্য বিকল্প বাড়ি বানিয়ে দেওয়া অথবা নগদ
• অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা ও পরিবহণ খরচ বাবদ অর্থ ইত্যাদি। এ ছাড়া তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং বিভিন্ন ছোট পেশার কাজের সঙ্গে যুক্ত পরিবারকে আরও কিছু অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব।
সরকারের একটি বড় অংশের বক্তব্য, এ রাজ্যে শিল্পের জন্য উপযুক্ত জমির সিংহভাগ রয়েছে গ্রামাঞ্চলে। সেখানে এই সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গেলে একটি জমিদাতা পরিবারকে যা দিতে হবে, তা সরকারের কোনও দফতরের পক্ষে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। উদাহরণ হিসাবে তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি আয়লা-বিধ্বস্ত এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য যাঁদের জমি নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের প্রত্যেকটি পরিবারের এক জনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে বলে ক্ষমতায় এসেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ১৮৯৪ সালের কেন্দ্রীয় অধিগ্রহণ আইন মেনে (যে হেতু রাজ্যের নতুন আইন চালু হয়নি) জমি নেওয়ার কাজ শুরু হলেও মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো চাকরি বা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উচ্চ-বাচ্য নেই। কারণ, এ জন্য যে অতিরিক্ত আর্থিক দায়িত্ব নিতে হবে, তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে প্রকল্পের রূপকার রাজ্য সেচ দফতর। এই অবস্থায় সরকারের একটি অংশের মতে, ক্ষতিপূরণের যে দীর্ঘ তালিকা রয়েছে বিলে, তার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘অথবা’ থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি, যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্যও বিলে জমি অধিগ্রহণের সংস্থান থাকা দরকার বলে মনে করছেন ওই মতাবলম্বীরা। তাঁরা মনে করেন, পরিকাঠামো ও পরিষেবা সংক্রান্ত যৌথ প্রকল্পের ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের দাবি যুক্তিযুক্ত। কারণ, একা সরকারের পক্ষে শিল্পের উপযোগী পরিকাঠামো তৈরির জন্য বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। |