তাঁরা কখনওই সংবাদমাধ্যমের উপর কোনও রকম ‘হস্তক্ষেপের’ পক্ষপাতী নন বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের জোটশরিক কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “স্বাধীনতার পর থেকে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন-সহ বিভিন্ন সংস্থার স্বাধীনতাকেই সমর্থন করেছে কংগ্রেস। যাতে এই সংস্থাগুলি সরকারের কাজের সমালোচনা করতে পারে।”
সংবাদপত্র নিয়ে রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার দফতরের নির্দেশিকার পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক দিন ধরেই উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। সেই পটভূমিকায় প্রণববাবুর এ দিনের মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। এমনিতেই প্রদেশ কংগ্রেস এবং কংগ্রেস পরিষদীয় দল ওই বিষয়ে তাদের ‘আপত্তি’র কথা জানিয়েছে। বস্তুত, সরকারি গ্রন্থাগারে কিছু সংবাদপত্র না-রাখার ‘নিষেধাজ্ঞা’ প্রত্যাহার করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করে চিঠিও দিচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। এ দিন প্রণববাবুর মাপের নেতার কথায়ও স্পষ্ট যে, এই প্রশ্নে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব রাজ্য শাখার পাশেই রয়েছেন। প্রণববাবুর কথায় আরও একটি বিষয় পরিষ্কার তাঁরা সরকারের বিভিন্ন কাজের ‘সমালোচনা’র বিরোধী নন। সংবাদমাধ্যমের একাংশের উপর মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘উষ্মা’ মূলত সরকারের সমালোচনার কারণেই। যার রেশ টেনে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, “মানুষ কোন কাগজ কিনে পড়বে, সেটা তো আমরা এখনও বলিনি। আগামী দিনে বলব। কারণ, বিষয়টা আমাদের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্তের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে!”
মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য নিয়ে যখন সর্বস্তরে ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’র মধ্যেই শনিবার মৌলালিতে কংগ্রেস সেবাদলের প্রশিক্ষণ শিবিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রণববাবু সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেন। কোনও রাজনৈতিক দলের নাম না-করলেও তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসের আন্দোলনের পথ পরিবর্তন হয়েছে। নিরন্তর গণ-আন্দোলনের মধ্যেই কংগ্রেসের বিবর্তন-পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এই পরিবর্তনটা ধ্বংসাত্মক নয়। সৃজনাত্মক।” কংগ্রেস নেতাদের একাংশের মতে, প্রণববাবুর ওই বক্তব্যে আসলে জোটশরিক তৃণমূলের বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে ‘উষ্মা’ প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস উল্লেখ করে কর্মীদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করার ফাঁকেই বর্ষীয়ান নেতা বলেছেন, “নিরন্তর পরিবর্তনের নীতিতে চলেই জাতীয় কংগ্রেস সাফল্য পেয়েছে। তবে সাফল্য মানেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়া নয়!” রাজ্য কংগ্রেসের এক নেতার বক্তব্য, ‘পরিবর্তন’ শব্দটি উল্লেখ করে প্রণববাবু আসলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীকে ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন।
সরকারি গ্রন্থাগারে সংবাদপত্রের ‘আমরা-ওরা’ বিভেদের বিরোধিতায় প্রথম থেকেই সরব কংগ্রেস। যে সংবাদপত্রগুলি গ্রন্থাগারে রাখার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, সেগুলি ‘মুক্ত চিন্তার প্রসারে’র পরিচায়ক বলে রাজ্য সরকার যে প্রাথমিক ‘যুক্তি’ দিয়েছিল, তা খারিজ করে প্রদেশ সভাপতি প্রদীপবাবু আগেই বলেছিলেন, “এই নির্দেশে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটতে পারে না। এ সব অবরুদ্ধ চিন্তাধারা।” তা সত্ত্বেও সরকার তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় এ বার সরাসরি চিঠি দিয়ে ওই নির্দেশিকা প্রত্যাহারের আর্জি জানাবে কংগ্রেস। প্রদীপবাবুর কথায়, “কোন সংবাদপত্র পড়ব আর কোনটা পড়ব না, সরকার এটা ঠিক করে দিতে পারে না। দেশের কোথাও এমন নিয়ম নেই। মানুষ মনের খোরাক যেখানে খুঁজে পাবে, সেই কাগজই পড়বে। প্রয়োজনে একাধিক কাগজ পড়বে। মানুষের নিজস্ব পছন্দমাফিক হবে সংবাদপত্র বাছাই। সরকারি নির্দেশিকা তুলে নিতে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব।”
সংবাদপত্র-বিতর্ক নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম আগেই বিধানসভার অন্দরে সরব হয়েছিল। এ দিন দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু ওই বিষয়ে যথেষ্ট ‘কড়া’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ওই প্রশ্নে মমতা-জমানাকে প্রকারান্তরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের শাসনকালের চেয়েও খারাপ বলে অভিহিত করেন বিমানবাবু। তাঁর কথায়, “যা করছেন, তাতে মনে হচ্ছে উনি (মমতা) সকলের মুখ্যমন্ত্রী নন। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি কী, উনি তা-ই বোঝেন না!” দেশের অন্য কোনও রাজ্য, এমনকী, প্রতিবেশী রাজ্য বিহার, ওড়িশা, অসমের কোনও মুখ্যমন্ত্রী এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ‘ফতোয়া’ জারি করেননি জানিয়ে বিমানবাবু বলেন, “একমাত্র তালিবান শাসনে এমন ফতোয়া দেখা যায়। জরুরি-শাসন জারির পিছনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাত ছিল। কিন্তু তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এমন কোনও ফতোয়া জারি করেননি!”
সংবাদমাধ্যম-বিতর্কে এ দিন উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে রাস্তায় নেমেছিল সিপিএম। শিলিগুড়ি জোনাল কমিটির তরফে হিলকার্ট রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য-সহ জেলা সিপিএম নেতারা। অশোকবাবু বলেন, “সম্প্রতি তিনটি জেলা পরিষদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ও গ্রন্থাগারে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি সংবাদপত্র রাখার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। সে জন্যই আমরা পথে নামতে বাধ্য হয়েছি।”
এ দিনই কলকাতায় এক দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বিজেপি-র জাতীয় মুখপাত্র তথা সাংসদ প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, “মানুষ কোন সংবাদপত্র পড়বেন, বা কোন চ্যানেল দেখবেন, তা মানুষই ঠিক করবেন। সরকারের তা ঠিক করে দেওয়া উচিত নয়। এই ধরনের কাজের জন্যই মানুষ ’৭৭ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে জনতা দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ঠিকমতো আচরণ না করলে মানুষ ভালবাসবে না। ক্ষমতায় যেমন যাওয়া যায়, তেমনই ক্ষমতা থেকে সরেও যেতে হয় এ কথা মনে রাখা উচিত।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ জানান, ওই নির্দেশিকার প্রতিবাদে আগামী কাল, সোমবার তাঁরা কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল করবেন। মিছিলের শেষে নির্দেশিকার প্রতিলিপি পোড়ানো হবে। |