প্রবন্ধ ...
প্রেম = দখল
ফাল্গুনের বিকেলে আচমকা বাতাসে মাথা নুইয়ে দোল খেত ডালপালাগুলো। রোদ হেলে গেলে তার তলায় গোল হয়ে বসে আড্ডা। চমৎকার গাইত একটি মেয়ে: ‘ওরে পলাশ, ওরে পলাশ... দখিন হাওয়ায় কুসুমবনের বুকের কাঁপন থামে না-যে।’ এ সব আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন। তা প্রায় পঁচিশ পেরিয়ে তিরিশ বছর হতে চলল।
আমরা যতই তারিফ করি না কেন, মেয়েটি কিন্তু গানটাকে ‘কেরিয়ার’ করেনি। বিয়ে করে প্রথমে কলকাতার, পরে দেশের বাইরে চলে যায়, বিয়ে করেছিল পছন্দের ছেলেকেই। হালে ফাল্গুনের এক বিকেলে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা, অ্যাকাডেমি-র সামনে। ‘নাটক দেখতে? কলকাতায় কবে এলি? তোর বর কোথায়?’ আমার শেষ প্রশ্নের উত্তরে আমিই অস্বস্তিতে পড়ি। বরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে মেয়েটির, কলকাতায় ফিরেছে কয়েক বছর হল, আর নাটক দেখতেই এসেছে। অস্বস্তি কাটানোর জন্যে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করি, কোন নাটক? ‘অন্ত আদি অন্ত’।
কাছে? না, দূরেই! ‘নান্দীকার’-এর ‘অন্ত আদি অন্ত’ নাটকের একটি দৃশ্য।

‘সত্তর দশকে বিয়ে ভাঙাভাঙির ব্যাপারটা ছিল না তা তো নয়, কিন্তু লুকোনো থাকত, আলোচনায় আনতে চাইত না বাঙালি মধ্যবিত্ত। এখন অনেকেই খোলাখুলি কথা বলে এ নিয়ে। মার্গরিৎ দ্যুরাস্-এর মূল রচনা থেকে নাটকটা লিখেছিলাম সত্তর দশকেই, এখন এটা করা জরুরি মনে করছে দেবশঙ্কর (হালদার) সোহিনী (সেনগুপ্ত)-রা, দেবশঙ্কর নির্দেশকও এ-নাটকের।’ বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। আমিও সে দিন নান্দীকার-এর নতুন নাটক ‘অন্ত আদি অন্ত’ দেখতে গিয়েছিলাম।
সওয়া এক ঘণ্টার নাটকের শুরুতেই বেরোল ডিভোর্সের রায়। তারপর পুরুষ আর মেয়েটি দু’জনে মিলে সন্ধে থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কারণ খুঁজতে থাকে কেন বিয়েটা ভাঙল, তারা তো ভালবেসেই বিয়ে করেছিল। আসলে বিয়েটাকে প্রেমের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধরে নিলে ভুলের শুরু সম্ভবত সেখান থেকেই। প্রেমের একটা শারীরিক লাইসেন্স নিশ্চয়ই বিয়ে, তবে শরীরেই তো আর থিতু হয় না প্রেম, ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় বহু দূর, রহস্যময়তাই তার স্বভাব।
এ-নাটকে মেয়েটি যেমন বিয়ের কিছুকাল পর থেকেই, হয়তো-বা শরীর বিনিময়ে শ্রান্ত হয়ে পড়ার পর থেকেই তাদের প্রেমের পুরনো বা প্রথম দিককার অনুভূতিগুলি ফিরে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে টের পায় দাম্পত্যের দৈনন্দিনে পুরুষ-স্বামীটির থেকে সে আর তাদের প্রেমের আদি অনুভূতিগুলি ফিরে পাচ্ছে না। ফলত মেয়েটি কখনও একা গাড়ি চালিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কখনও-বা বলে বেরোবে না, অথচ কাউকে না বলেই হঠাৎ রেসকোর্সে চলে যায়। কখনও ঢুকে পড়ে সিনেমা হলে।
উল্টো দিকে পুরুষটি কিন্তু ভয় পেতে শুরু করে, তার স্ত্রী বোধহয় দ্বিতীয় পুরুষের সন্ধান করছে। প্রতিবারই পুরুষটি প্রবল সন্দেহ নিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করে, অথচ গিয়ে দেখে তার স্ত্রীর সঙ্গে কেউই নেই, কেউই ছিল না। বিয়ে ভাঙার পর মেয়েটি তাকে বলেই ফেলে: ‘তাও কোনও পুরুষ তুমি আমার সঙ্গে আবিষ্কার করতে পারনি, তাই না?’ পুরুষটি যেহেতু যন্ত্রণা পায়, স্বীকার করে ‘ক্রমশ সাফার করতে লাগলাম... সাংঘাতিক একটা অনুভূতি: তোমার কী যেন একটা অচেনা থেকে যাচ্ছে আমার কাছে...।’
‘এক ম্যায় অওর এক তু’ ছবির একটি দৃশ্য।

বোঝা যায়, পুরুষটি possess করতে চাইছে মেয়েটিকে, কিন্তু পারছে না, না-শরীরে না-মনে, আর সেখানেই তার না-পারার এবং না-পাওয়ারও যন্ত্রণা। এই দখলদারির মানসিকতাই তাকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেয় তার স্ত্রীর থেকে। পুরুষের এটাই সমস্যা, সে দখলকে প্রেমের পরিপূরক বলে, বস্তুত প্রেম বলে ভাবতে থাকে, ফলে মেয়েটিকে তো পায়ই না, তার নিজস্বতাকেও ছুঁতে পারে না। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত পুরুষের কাছে প্রেমের একটা শারীরিক পরিণতিই হয়ে থাকে, মানসিক অনুভূতি হয়ে ওঠে না।
প্রেমের ব্যাপারে বিয়েটা একটা বাধাই হয়ে দাঁড়ায় শেষ অবধি, বিশেষত পুরুষেরা সচরাচর প্রেমটাকে শরীর ছাপিয়ে মনে পৌঁছতে দেয় না বলেই বোধহয়। প্রেমের রহস্যময় মুক্তিও তাই অধরাই থেকে যায়। মার্গরিৎ বা রুদ্রপ্রসাদের নাটকে তা যে অনেকটাই স্পষ্ট, জানিয়ে দিই দেবশঙ্করকে, নাটক দেখে ফেরার পর। যেটা তাঁকে জানানো হয় না তা হল, বাড়ি ফিরে রবীন্দ্রনাথ ওল্টাতে গিয়ে দেখি ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’তে তিনি লিখছেন: ‘মেয়ের জীবনে সকলের চেয়ে বড়ো সার্থকতা হচ্ছে প্রেমে। এই প্রেমে সে স্থিতির বন্ধনরূপ ঘুচিয়ে দেয়; বাইরের অবস্থার সমস্ত শাসনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।’

এ রকমই একটি মেয়েকে দেখলাম ‘এক ম্যায় অওর এক তু’-তে। কোকিল-ডাকা মধ্যদুপুরে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম শাকুন বাত্রা-র ছবিটা। আমার বাল্যবন্ধুটি মনোবিদ, সে আমাকে প্রায়ই বলিউডের প্রেমের ছবি দেখাতে নিয়ে যায়, বলে: ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা প্রেম নিয়ে কী ভাবে তার একটা আন্দাজ পাবি।’
এ-ছবিতে মেয়েটি দস্যি, সামাজিক নিয়ম-শাসন তোড়ফোড় করে তুলকালাম বাধিয়ে দেয়। তার পুরুষ-বন্ধুটির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটছিল না বাপ-মায়ের অভিভাবকত্বের চাপে, মেয়েটি তাকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করে তোলে। ব্যস্, ছেলেটি মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়, সংবেদনশীল হওয়া সত্ত্বেও আর-পাঁচটা পুরুষের মতোই তাদের সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় বিয়েতে। মেয়েটি ‘না’ বলে। এর আগেও সে গোটা দুয়েক সম্পর্ক পেরিয়ে এসেছে, এখন সে একা থাকতে চায়। ছেলেটির সঙ্গে সে অবশ্যই পুরোদস্তুর সম্পর্ক রাখতে চায়, তাকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে করে, নিজের জীবনের প্রায় সব নিভৃত অনুভূতির কথাই সে ছেলেটিকে জানায়, এমনকী তাকে ‘আই লাভ ইউ’ও বলে, কিন্তু প্রেম-বিবাহের সামাজিক বন্ধনে জড়াতে সে নারাজ।
এই যে দখলদারির অভ্যেস, তা থেকে পুরুষ কিছুতেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না। মেয়েরাও যে দখল করতে চায় না তা নয়, জোয়া আখতার-এর ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’-তে দেখেওছি সে রকম মেয়ে, পছন্দের পুরুষটিকে বশে রাখার জন্যে তাকে সন্দেহ করাই ছিল মেয়েটির বাতিক। এটা আসলে কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, একটা সামাজিক ব্যবস্থার অংশীদার আমরা সকলেই। পিতৃতন্ত্রের শাসনেই তো চলে গোটা সমাজটা, ফলে দখলটাকে যে কোনও সম্পর্ক কিংবা প্রেমে ‘আবশ্যিক’ বলে ঠাওর হয়! ‘স্বাভাবিক’ বলেই মেনে নিই আমরা।
ছবি দেখে এ সব কথাবার্তা কইতে-কইতে বেরোচ্ছি দুই বন্ধু, দেখি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মেয়েটি। শুধোলাম ‘গানটা কি ছেড়ে দিয়েছিস?’ মেয়েটি বললে ‘একেবারেই না। একা থাকি তো, গানটাই করি সবচেয়ে মন দিয়ে।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.