‘জীবনে কখনও যন্ত্রণায় বেঁকে গিয়ে লড়াই থামিয়ে দিইনি’
পেনশন প্রকল্প সরকারি ভাবে তাঁর আজ থেকেই শুরু। ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত সেই সংবর্ধনা নিতে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগে অনুষ্ঠান কেন্দ্র সংলগ্ন হোটেল ঘরে বসে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন রাহুল দ্রাবিড়। অবসরের পর প্রিন্ট মিডিয়াকে দেওয়া প্রথম ইন্টারভিউ।

প্রশ্ন: আপনি নিজে ভেবেছিলেন, অবসরের পর দেশ জুড়ে এমন উথালপাথাল প্রতিক্রিয়া হবে?
দ্রাবিড়: একেবারেই ভাবিনি। ইন ফ্যাক্ট প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা দেখে আমি খুব নতমস্তক হয়ে পড়ছি। চারদিকে যেখানে যাচ্ছি লোকে এত রকম কথা বলছে।

প্র: কী বলছে?
দ্রাবিড়: কেউ বলছে অভিনন্দন। ভেরি ওয়েল ডান। কেউ বলছে ভুলব না। কেউ বলছে আর একটু খেললে পারতেন। প্লেনের মধ্যে-ফাংশনে-হোটেলে সর্বত্র লোকে এসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক-এক সময় লজ্জাই লাগছে।

প্র: আর মনে হচ্ছে ধন্য, এ জন্যই তো মন দিয়ে ক্রিকেট খেলা।
দ্রাবিড়: ঠিক তা নয়। আমি তো এ রকম লক্ষ্য সামনে রেখে খেলিনি যে রিটায়ারমেন্টের পরেও এই রকম প্রতিক্রিয়া হবে। আমি নিছক খেলাটাকে ভালবেসে সেটাকেই ধ্রুবতারার মতো আঁকড়ে ছিলাম। সেটা করতে গিয়ে কোনও দিন এত লোকের জীবনে যে আমার একটা পেশাদারি সিদ্ধান্ত এমন প্রভাব ফেলতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি।
আর আপনার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হল, এখন এক-এক সময় মনে হচ্ছে হ্যাঁ, আমি অন্তত ঠিক ট্র্যাকেই দৌড়েছিলাম!

প্র: একটাই খটকা থাকছে। আপনার সিদ্ধান্ত যখন অ্যাডিলেডেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তখন ঘোষণাটা অস্ট্রেলিয়ায় হল না কেন?
দ্রাবিড়: কারণ আমি হুড়ুমতাল কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। আমি যে বয়সে এসে পৌঁছেছি, সেখানে অনেক কিছু বিবেচনার ব্যাপার থাকে। প্রত্যেকটা সিরিজ শেষে খতিয়ে দেখতে হয়। বেশ ভেবেচিন্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিই। যাতে যুক্তিকে আবেগ কোনও ভাবে প্রভাবিত না করতে পারে।

প্র: কিন্তু আবেগেরও একটা অপরিসীম মূল্য থাকে। এই যে এত লোক আজও মুম্বইতে আপনাকে বলছে, কেন গেলে? কেন আরও একটা বছর থাকলে না?
দ্রাবিড়: এই প্রতিক্রিয়াকে সম্মান করেও আমি বলছি গরিষ্ঠের মনোভাব তা নয়। আমি যা ফিডব্যাক পেয়েছি তাতে বেশির ভাগ লোক আমায় বলেছে, ঠিক সময় বেছেছ।

প্র: আমি আপনাকে গাঙ্গুলির শহরের ঠিক তখনকার অভিব্যক্তি জানাতে পারি: এই রে, ভারত অরক্ষিত হয়ে পড়ল! বিদেশের মাঠে ভারত প্রথম ওভারেই ০-১। প্যাভিলিয়ন থেকে ওই ছায়াটাই বের হবে না শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যে ইনিংসটাকে বাঁচিয়ে রাখত।
দ্রাবিড়: এগুলো কোনও সমস্যা নয়। কোহলিরা তো উঠে এসেছে। তা ছাড়া কোনও কিছুর জন্যই কিছু অপেক্ষা করে থাকে না। প্লেয়ার আসে-যায়। দিন বদলায়। খেলাটা বেঁচে থাকে। গাওস্কর চলে গিয়েছেন। কপিল দেব চলে গিয়েছেন। গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। তার পাশে রাহুল দ্রাবিড় কে!
মুম্বইয়ে বোর্ডের অনুষ্ঠানে দ্রাবিড়। ছবি: পিটিআই।

প্র: আপনার নিজের কী মনে হয়? দ্রাবিড়-পরবর্তী যুগে ভারতের আইডিয়াল তিন নম্বর কে হবে?
দ্রাবিড়: বলা মুশকিল এক জন নির্দিষ্ট কাউকে। বিরাটকে তো আমরা দেখছি দারুণ খেলছে। রোহিত শর্মা আছে। অজিঙ্ক রাহানে ভাল ব্যাট করে। তারপর মনোজ তিওয়ারি। তার পর...

প্র: আপনি তো রাহুল দ্রাবিড়। মাদার টেরিজা হয়ে যাচ্ছেন কেন?
দ্রাবিড়: কেন, মাদার কেন হতে যাব...

প্র: আপনার কি মনে হচ্ছে না কথা বলতে বলতে সাংঘাতিক রকমের দয়ালু হয়ে পড়ছেন? এতগুলো যোগ্য পরিবর্ত সত্যি থাকলে আপনার কি মনে হয় অবসরোত্তর এই প্রতিক্রিয়াটা পেতেন?
দ্রাবিড়: এক দিনে তো কেউ নাম কিনে ফেলে না। আমি যে বিশ্বাসযোগ্যতাটা আজ অর্জন করতে পেরেছি তা তো এত বছর টানা সুযোগ পাওয়ার পর। যে লোকটা টানা পনেরো বছর খেলেছে, সদ্য আসা এক জন তরুণ কী করে তার রেডিমেড পরিবর্ত হবে? সুযোগ দিতে হবে তো। আমি আর সৌরভ যখন ১৯৯৬-তে শুরু করেছিলাম, তখনও কেউ ভেবেছিল আমরা এত দূর টানতে পারব?
ভাবা যায়ও না। আমি শুধু এটুকু আশা করব, যে-ই তিন নম্বর জায়গাটা নিক তার প্রতি বিশ্বস্ততা দেখাবে। ওই জায়গাটা ভীষণ ক্রিটিক্যাল। গোটা টিম তার ছায়া চায়।

প্র: আপনার কাহিনির দলগত বিদায়ের সময়টা শুধু ভাল হল না। অস্ট্রেলিয়া আর ০-৪ ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
দ্রাবিড়: খুব খারাপ লাগে। আমরা কী করতে চেয়েছিলাম আর শেষমেশ কী হয়ে দাঁড়াল। ভবিষ্যৎ ভারতীয় ক্রিকেট প্রজন্মের কাছে তাই আমার আরও বেশি করে অনুরোধ, বিদেশে টিমটাকে দাঁড় করাও। ওটাই আসল খেলা। আমাদের সময় আমরা বিদেশ লক্ষ্য করেই বরাবর প্রস্তুতি নিয়েছি। শেষ হার্ডলটায় আমরা হয়তো আটকে গিয়েছি এ বার। কিন্তু চেষ্টাটা যেন ভীষণ ভাবে চালু থাকে আগামী দিনে।

প্র: আগাথা ক্রিস্টির গল্পের মতো বলা যেতে পারে, রইল বাকি দুই। ক্রিকেটলিখিয়েদের তৈরি ম্যাগনিফিসেন্ট ফাইভের তিন জন চলে গেলেন। কুম্বলে, সৌরভ আর আপনি!
দ্রাবিড়: আমারও মনে হয় এখন অবধি বুঝিনি, কিন্তু যত সময় যাবে বুঝব কী কী সব প্লেয়ারের সঙ্গে এক ড্রেসিংরুমে কাটিয়ে গেলাম। এক এক জন লেজেন্ড। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে এদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছি। পাঁচ জনের মধ্যে পাঁচ জনই একশোর ওপর টেস্ট খেলেছে। বীরু সে-ও শিগগির একশো টেস্ট খেলে ফেলবে। মাত্র চারটে টেস্ট বাকি।
ভাবতে পারেন একটা টিমে একই সঙ্গে পাঁচ থেকে ছ’জন একশো টেস্ট বা তার কাছাকাছি থাকা লোক। ইতিহাসে ক’বার হয়েছে! কী পরিমাণ কমিটমেন্ট আর অভিজ্ঞতা তা হলে এই টিমটার মধ্যে ছিল যে এত জন এমন লম্বা দৌড়তে পেরেছে। মনে রাখবেন একশোটা টেস্ট কিন্তু ইচ্ছে করলেই খেলা যায় না।

প্র: বলা হচ্ছে দিনের শেষে রাহুল দ্রাবিড়ের কাহিনি এক মধ্যবিত্ত কিশোরের ঐশ্বর্যশালী হওয়ার। যে স্বপ্নকে দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে। স্বপ্নকে তাড়া করেছে কিন্তু নিজের মধ্যবিত্ত ভ্যালুজকে শত প্রলোভনেও বিক্রি করে দেয়নি।
দ্রাবিড়: এ ভাবে বলতে পারব না। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন দেখেছিলাম এটা ঠিক কথা। এটাও ঠিক, আমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী আপ্রাণ চেষ্টা কখনও থামিয়ে দিইনি। আই নেভার স্টপ্ড ট্রায়িং। মাঠে হোক, মাঠের বাইরে হোক, সব সময় চেষ্টা করেছি আমার যোগ্যতা যতটুকু দিয়েছে, তার সেরা মানুষটা যেন আমিই হতে পারি। আমার স্বাভাবিক দক্ষতায় যা এল না তা তো এলই না। কিন্তু যেটা তা থেকে আসার যেন ভরপুর আসে। জীবনে তাই কখনও যন্ত্রণায় বেঁকে গিয়ে লড়াই থামিয়ে দিইনি।

প্র: আর নিজের নীতি-আদর্শকে এত বছরেও কখনও বিকিয়ে না দেওয়া!
দ্রাবিড়: আশা করি সেগুলো বিসর্জিত হয়নি। তবে নীতি-আদর্শ এগুলো খুব যার-যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অনেকটাই আপেক্ষিক। আমি নিশ্চিত, আমার চেয়ে কঠোর নীতি নিয়েও অনেকে সেটা আঁকড়ে থেকেছে। আমি একা নই। আমি চেষ্টা করেছি নিজের নীতি অক্ষুণ্ণ রেখে খেলাটাকে খেলতে। নিজেকে ডোবাতে চাইনি নিজের কাছে। মাঠে কখনও জিতেছি। অনেক সময় হেরেছি। কিন্তু লোকে বোধহয় এটুকু বুঝেছে, এই ছেলেটা হেরেছে অনেক চেষ্টা করেও।

প্র: আজ থেকে তো সরকারি ভাবে আপনার পেনশন প্রকল্প শুরু।
দ্রাবিড়: এখনও চরম ব্যস্ততায়। বুঝতেই পারছি না যে অবসর নিয়েছি। আইপিএল প্র্যাক্টিসে দৌড়ঝাঁপ। বুঝব জুন থেকে। আইপিএল শেষ হওয়ার পর।

প্র: জুন থেকে পেনশনারের জীবন?
দ্রাবিড়: তখন থেকে বেকারের জীবন। (হাসি) ঘোর বেকারত্ব শুরু। পেনশন তো তবু ভাল। যাক, চললাম এখন। দৌড়তে হবে আমাকে।
প্র: দাঁড়ান, দাঁড়ান। লাস্ট প্রশ্ন। আইপিএল এ বারই শেষ তো? নাকি আগামী বছরও খেলবেন?
দ্রাবিড়: ঠিক করিনি। বললাম তো, এত আগে ঠিক করিও না। তবে চুক্তি এখন পর্যন্ত এক বছরের। এ বারেই শেষ।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.