|
|
|
|
প্রবন্ধ ... |
|
ব্যোমকেশই আমাকে বাঙালি করে তুলেছে
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘থ্রিলার’ পড়ে বাংলা শিক্ষা।
এ ভাবেই হাতে এল ব্যোমকেশ। তার পর? স্মৃতিতে আলো ফেললেন
অঞ্জন দত্ত |
|
আমি ব্যোমকেশ নই। অর্থাৎ, ব্যোমকেশ যে রকম, তা মোটেই আমার চাল-চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। তা হলে, ব্যোমকেশ আমাকে এত টানে কেন?
কারণ, সে আমার ঠিক বিপরীত মেরু। নিপাট ভদ্রলোক, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, সত্যান্বেষী হলেও বিয়েটিয়ে করে রীতিমতো গৃহপালিত সংসারী বাঙালি। আমি ঠিক সে রকম নই। কী জানি, নই বলেই হয়তো ব্যোমকেশ বক্সির সঙ্গে আমার আলাপ দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে।
বেনেপুকুর-এ বাড়ি, পড়তে গেলাম দার্জিলিং-এর সাহেবি ইশকুলে, সেখানে ইংরেজি প্রথম ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা ফরাসি। তার পর, স্কুলশেষের আগে দু’বছর আমার দ্বিতীয় ভাষা ‘বাংলা’ হল বটে, কিন্তু তার সঙ্গে মনের টান তেমন ভাবে জমল কই? কয়েকটা স্কুলপাঠ্য বই পড়েছিলাম, গল্পগুচ্ছও সে ভাবেই পড়া, কিন্তু বাংলা ঠিক সে ভাবে আমার মনে দাগ কাটল না।
তার পর বেশ কিছু দিন কেটেছে। আমি তখন খুব নাটক করছি, ইংরেজি নাটক, দূরদর্শনে তেমনই একটি নাটক করতে গিয়ে দেখা হল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, অভিনয় তো ভালই করো, বাংলা জানো?
বললাম, না, ততটা ঠিক জানি না।
অজিতেশ একটু বিস্মিত, তার পর বললেন, কিন্তু, বাংলা না-জানলে চলবে কী করে? বাংলা পড়তে শুরু করো। তোমার কী ধরনের বই পড়তে ভাল লাগে?
থ্রিলার।
খুব ভাল। বাংলায় প্রচুর ভাল থ্রিলার লেখা হয়েছে। সেগুলো মন দিয়ে পড়।
শুরু করলাম থ্রিলার-পাঠ। ফলে, আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে চিনলাম গোয়েন্দা পরাশর বর্মার সূত্রে, বিমল করকে কিকিরা-র সূত্রে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সূত্রে। এঁরা আরও অনেক বিশিষ্ট সাহিত্য রচনা করেছেন, কিন্তু আমার সঙ্গে এঁদের ‘রহস্য’ময় যোগ। তা ছাড়া, আরও কত! কিরীটি থেকে ফেলুদা, কিছুই ছাড়িনি। এই ভাবেই এক দিন হাতে এল ব্যোমকেশ বক্সি। |
|
দেখলাম, ব্যোমকেশ তো নিছকই রহস্য কাহিনি নয়, ব্যোমকেশ সাহিত্যও বটে। সাহিত্যিক হিসাবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার মতে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই উল্লেখের দাবি রাখেন। ব্যোমকেশ বক্সির মধ্যে বাঙালি জীবনের একটা বিশেষ সময়কালের ছবি নিপুণ ভাবে ধরা আছে। ফলে, ব্যোমকেশ পড়তে পড়তে, আস্তে আস্তে, আমারও এক ভাবে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠা শুরু হল।
আমি নিজে এক সময় ‘রুদ্র সেন’ নামে একটি গোয়েন্দা তৈরি করেছিলাম। তবে, সে অনেকটাই মার্কিন থ্রিলারের আদলে গড়া। রুদ্র সেনের ব্যক্তিত্বের ধাঁচটা কিছুটা আমার নিজের সঙ্গেও মেলে। সে নামে বাঙালি, কিন্তু চালচলনে যথেষ্ট বিদেশি ছায়া। বঙ্গজীবনের এই ধাঁচটা আমি খুব কাছ থেকে চিনি। আমার নানা ছবিতে, ‘বং কানেকশন’ বা ‘ম্যাডলি বাঙালি’ এদের অনেকের কথা এসেছে।
আমি একটার পর একটা এই ধরনের ছবি করতে করতে এক সময় ভাবলাম, একটু অন্য দিকে তাকালে কেমন হয়? আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। মা গান করতেন। দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদু অর্গান বাজাতেন। এই সব স্মৃতি বেনেপুকুরের এক বঙ্গসন্তানের মাথায় মেঘের মতোই ঘনিয়ে এল! সঙ্গে, আমার নিজের একটা শিকড়হীন অনুভূতি তো আছেই। সব মিলিয়ে মনে হল, আমার পরিচিত ছাঁচ থেকে বেরিয়ে অন্য রকম একটা ছবি করি। তাতে হাতে-ধরা ক্যামেরার ‘জার্ক’ থাকবে না। ‘জাম্প কাট’ থাকবে না। একেবারে ধ্রুপদী ঘরানায় ছবিটা হবে। কী ছবি করা যায়?
ব্যোমকেশ বক্সি।
|
ব্যোমকেশের দিকে |
বিভূতিভূষণের লেখায় যেমন অজস্র ‘ডিটেল’, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কিন্তু সে গোত্রের নয়। শরদিন্দুবাবু নিজে চিত্রনাট্য লিখতেন, তাঁর লেখার মধ্যেও সেই ধাঁচটা স্পষ্ট। অর্থাৎ, দরকারি তথ্যগুলো দিচ্ছেন, কিন্তু পাশাপাশি পরিচালকের জন্য অনেকটা জায়গাও ছাড়া থাকছে। যে ভাবে তিনি ছবিটা তুলতে চান, সেটা তিনি করতে পারবেন। সেই স্বাধীনতাটুকু তাঁকে দিয়েই রাখছেন শরদিন্দু। আগে ব্যোমকেশ নিয়ে বড় পর্দায় খুব বেশি কাজ হয়নি। সত্যজিৎ রায় করেছিলেন ‘চিড়িয়াখানা’। তাতে উত্তমকুমারের অভিনয় আমার ভাল লেগেছিল। এমনিতে আমি উত্তমকুমারের খুব একটা ভক্ত নই, কিন্তু ওই ছবিটায় উনি অভিনয়ে একটা বুদ্ধিদীপ্ত দাপট এনেছিলেন। সব মিলিয়ে ছবিটা আমার খুব ভাল লাগেনি। এ ছাড়া, মঞ্জু দে করেছিলেন ‘শজারুর কাঁটা’। সেটা বলার মতো কিছু না। ফলে, ব্যোমকেশ কী ভাবে করতে হয়, তার খুব বেশি আদল আমার সামনে ছিল না। সত্যজিৎ রায় ‘চিড়িয়াখানা’তে যতটা স্বাধীনতা নিয়েছিলেন, আমি ঠিক ততটা স্বাধীনতা নেওয়ার পক্ষপাতী নই।
তা হলে, কতটা স্বাধীনতা নেব? আমার মতে, লেখকই সর্বাগ্রে। আমি নিজের মতো করে জিনিসটা ভাবতে পারি, কিন্তু লেখক নিজে কী ভেবেছিলেন, কী ভাবে ভেবেছিলেন, সেটা মাথায় রাখতেই হবে। এই জিনিসটা, আমার কাছে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আ পিরিয়ড ইজ আ পিরিয়ড। সে জন্যেই আমি ব্যোমকেশ বক্সিকে কখনও এই সময়ে আনার কথা ভাবিনি। শরদিন্দু তাঁর লেখায় যে ‘পিরিয়ড’-টা ধরেছেন, আমি খুব বিশ্বস্ত ভাবে সেই সময়টাকে ধরতে চেয়েছি। আর, সময়টাকে ছবির ভাষায় যথাসাধ্য নিখুঁত ভাবে ধরতে গিয়ে, নিশ্চিত, আমি আরও খানিকটা বাঙালি হয়ে উঠেছি।
কারণ, পর্দায় সেই সময়ের বাঙালি জীবনটা তুলে আনতে হবে। যে গল্প নিয়ে ছবি, সেটা তো বটেই, পাশাপাশি সেই সময়ের আরও পাঁচটা লেখা পড়তে হবে, শরদিন্দুর তো বটেই, অন্য আরও কিছু লেখা। তৎকালীন সমাজের নানা রকম তথ্য জোগাড় করতে হবে তবেই না ব্যোমকেশ বক্সির বাঙালিয়ানা জীবন্ত হয়ে উঠবে। এই খেলাটা দারুণ লাগে বলেই ব্যোমকেশের কাছে ফিরে ফিরে আসি।
তা ছাড়া, যে কোনও পরিচালকই একটা না একটা ‘থ্রিলার’ করতে চান। কারণ, ‘থ্রিলার’-এ যে ভাবে গল্পটা এগোয়, রহস্যটা ঘনিয়ে তোলা, তার পর আস্তে আস্তে তার সমাধান, সেটা করতে গেলে দারুণ একটা মুনশিয়ানা লাগে। রহস্য থেকে সমাধানে পৌঁছনোর এই যাত্রাপথটা সব পরিচালকই উপভোগ করেন। আমিও।
খটকা একটাই। রহস্যের সমাধান হল মানে দর্শকের উৎসাহ শেষ। অথচ, ছবিটা তখন শেষ না-ও হতে পারে। তা হলে? এও এক সত্য। রহস্য কাহিনির সত্য। সেই সত্যটুকু এখানে, এই লেখায় উহ্য থাক। অজিত হয়তো জানে, কিন্তু সে-ও বলবে না। সত্যান্বেষীর বারণ! |
|
|
|
|
|