বামফ্রন্ট সরকার তিন দশকে যাহা পারে নাই, তৃণমূল-কংগ্রেস জোট সরকার নয় মাসেই তাহা করিয়াছে। রাজ্যের অর্ধেক নাগরিককে ‘প্রতিবন্ধী’ করিয়া দিয়াছে। অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতার ইংরাজি সংস্করণে ‘নারী ও শিশু উন্নয়ন’ বিষয়ে বলা হইয়াছে, ‘মহিলা ও শিশুরা শারীরিক এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধী।’ বাংলায় অবশ্য অতটা সদয় হন নাই তিনি, মহিলাদের ‘দুর্বল’ বলিয়াছেন কেবল। এই দুর্বলতা/প্রতিবন্ধ ঘুচাইতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে সবল করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন তিনি। কোন প্রণালীতে খিচুড়ি রাঁধিলে প্রতিবন্ধ দূর হয়, তাহা বোধ করি মা মাটি মানুষের সরকারের জানা আছে। উনিশ শতকে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকা বাহির করিয়াছিলেন। অমিত মিত্র হয়তো নিজেকে এ যুগের ‘অবলাবান্ধব’ বলিয়া দেখিতে চাহেন। বাজেট-পরবর্তী সাংবাদিক বৈঠকে স্বভাবদৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রীর পাশে উপবিষ্ট অর্থমন্ত্রীকে দেখিয়া অবশ্য সন্দেহ হইয়াছে, বলহীনতা নারীর একান্ত বৈশিষ্ট্য না-ও হইতে পারে। পুরুষরাও যাহাতে প্রয়োজনে অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি খাইতে পারেন, তাহার ব্যবস্থা করিবেন কি না, সেই বিষয়ে মিত্রমহাশয় মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ লইতে পারেন।
মহিলাদের বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজন, অমিতবাবুর এই মন্তব্য অতি সঙ্গত। তবে সম্প্রতি কলিকাতার মহিলা কলেজগুলিতে যাহা ঘটিতেছে, তাহাতে শিক্ষক এবং পুলিশ, উভয়ের নিকটই মহিলাদের হইতে সুরক্ষা প্রশ্নটিও গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে। গত সপ্তাহে বিদ্যাসাগর কলেজের শতাধিক ছাত্রী দিনভর অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের ঘেরাও করিয়াছেন, ঘর ভাঙচুর করিয়াছেন এবং শেষ অবধি রাস্তা অবরোধ করিয়াছেন। তাঁহাদের দাবি, ক্লাসে উপস্থিতি কিংবা পরীক্ষার নম্বর যথেষ্ট না হইলেও পরীক্ষায় বসিবার অনুমতি দিতে হইবে। একই দাবিতে কিছু দিন পূর্বে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে তুলকালাম করিয়াছিলেন ছাত্রীরা। উভয় ক্ষেত্রেই ‘বিশেষ সুরক্ষা’ মহিলাদের প্রাপ্য ভাবিয়া পুলিশ বহু ক্ষণ নিষ্ক্রিয় ছিল। বিশৃঙ্খলা চূড়ান্ত হইলে তবেই হস্তক্ষেপ করিয়াছে।
দল বাঁধিয়া যাহারা অপরকে উত্ত্যক্ত করে তাহারা বিশেষ সুরক্ষা পাইবার অধিকারী নহে। কে বলপ্রয়োগ করিতেছে, ইহাই একমাত্র বিচার্য নহে, কী উদ্দেশ্যে, কী উপায়ে, কাহার উপর বলের প্রকাশ হইতেছে, তাহাও পুলিশ-প্রশাসনকে বুঝিতে হইবে। এ রাজ্যে কার্যত ঘটিতেছে তাহার উলটো। যে মেয়েটি রাস্তায় কিংবা ট্রেনে-বাসে সমাজবিরোধীদের দ্বারা নির্যাতিত হইয়া পুলিশের নিকট সাহায্য চায়, সে প্রায়শই প্রত্যাখ্যাত হয়। সম্প্রতি তাহার বেশ কিছু নিদর্শন আমাদের সম্মুখে আসিয়াছে। কিন্তু অনেকগুলি মেয়ে যখন অন্যায্য দাবিতে অপরের উপর পীড়ন করিতেছে, তখন পুলিশ তৎপর হয় নাই। নারীমাত্রই দুর্বল, এমন মনোভাব এক দিকে নারীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে, অপর দিকে প্রশাসনকে প্রতিবন্ধী করিয়া তোলে। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ, নারীদের সক্ষমতা বাড়াইবার কথা বলুন। মেয়েদের দুর্বলতা-প্রতিবন্ধ লইয়া তাঁহার বিচার বরং অনুক্ত থাক। বিধানসভা, মহাকরণ সারিয়া মন্ত্রিমহাশয়গণকেও তো গৃহে ফিরিতে হয়। |