আমরির ঘটনা বেআব্রু করে দিয়েছিল হাসপাতাল, নার্সিংহোমের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ছবিটা। আরোগ্যকেন্দ্রে বিপন্ন প্রাণের ছবিতে ছড়িয়েছিল আতঙ্ক। গত ডিসেম্বরে সেই ঘটনার পর প্রশাসনিক স্তরে প্রচুর তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। কলকাতা শহর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলিতে পরিদর্শনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। তারপরেও যে ছবিটা বিশেষ বদলায়নি, বুধবার মেদিনীপুর শহরের নার্সিংহোমে অগ্নিকাণ্ড তা প্রমাণ করে দিয়েছে। একই চিত্র জেলার আরও এক শহর ঘাটালেও।
ঘাটাল মহকুমার সদর শহর। গোটা মহকুমার ৩২টি নার্সিংহোমের মধ্যে ২৬টি-ই রয়েছে ঘাটাল শহরে। তার মধ্যে ২৫টিই আবার কুশপাতা এলাকায়। সেগুলির কোনওটিতেই যথাযথ পরিকাঠামো নেই। ঘিঞ্জি রাস্তার ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মাথা তুলেছে নার্সিংহোমগুলি। নেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক-নার্সও পর্যাপ্ত নয়। কেউই নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ নিয়মকানুন সম্পর্কে অবগতও নন। ঘাটালের মানুষ এই পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনিক গাফিলতির দিকেই আঙুল তুলছেন। তাঁদের প্রশ্ন, যথাযথ পরিকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে মিলছে ছাড়পত্র!
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী নার্সিংহোমের অনুমোদনের জন্য কোনও ফায়ারের লাইসেন্স প্রয়োজন নেই। আমরি-কাণ্ডের পরেও এ নিয়ে সরকারি নির্দেশ জারি হয়নি। তবে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে যে দল হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলি পরিদর্শনে গিয়েছিল, তাতে রাখা হয়েছিল দমকল এবং পুরপ্রধানের প্রতিনিধিদের। ঘাটালেও নিয়মমাফিক পরিদর্শন হয়েছিল ওই সময়। হাসপাতাল, নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে সেই সময় দাহ্যবস্তু মজুত না রাখা-সহ যাবতীয় অগ্নিবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে কি না, তা আর দেখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্রের বক্তব্য, “আমরা সব নার্সিংহোম মালিকদের অগ্নিবিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছি। সবাই তা মেনে চলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। কিন্তু এখনও যদি তা মানা না হয়, তবে খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।”
কলকাতার আমরি ও মেদিনীপুরের নার্সিংহোমটিতে বেসমেন্টে মজুত দাহ্যপদার্থ থেকেই আগুন ছড়িয়েছিল। তবে বেসমেন্ট বলতে যা বোঝায়, ঘাটালের কোনও নার্সিংহোমেই তা নেই। তবে শহরের ২৬টি নার্সিংহোমের কোনওটিতেই অগ্নিবিধি মানার বালাই নেই। সংকীর্ণ রাস্তার ধারে মাথা তুলেছে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম। রাস্তা এতই অপরিসর যে দমকল ঢোকা কঠিন। ৫ থেকে ১৫ শয্যার নার্সিংহোমগুলিতে নীচতলাতেই থাকেন রোগীরা। আর নীচতলারই কোনও ঘরে ডাঁই করে রাখা হয় ওষুধ, তুলো, গজ, ব্যান্ডেজের মতো দাহ্যবস্তু। অধিকাংশ নার্সিংহোমে রয়েছে বাতানুকূল যন্ত্র। অথচ শহরের দু’-চারটি বাদে কোনও নার্সিংহোমে বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করা হয় না। পর্যাপ্ত জলের বন্দোবস্তও নেই। অঘটন ঘটলে ভাগ্যই ভরসা।
নার্সিংহোম মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিদর্শকদের নির্দেশ মতো প্রাথমিক ভাবে অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবস্থা হয়েছে (যদিও সর্বত্র কেনা হয়নি)। দমকল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকলেই তো হবে না, তা ব্যবহার করতেও তো জানা চাই। নার্সিংহোম মালিক সংগঠনের পক্ষে অনুপ চক্রবর্তীর দাবি, “সরকারি নিয়ম মেনেই চলছে নার্সিংহোমগুলি। নির্দেশমতো আমরা অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র কিনে স্বাস্থ্য দফতর এবং দমকল বিভাগকে জানিয়েছি। সরকারি ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে আমাদের কী করার আছে?” মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্র বলেন, “যন্ত্রের প্রশিক্ষণ তো আমরা দেব না, সেটা দমকলের কাজ।” ঘাটালের দমকলের ওসি রবীন্দ্রনাথ বেরার বক্তব্য, “এটা দফতরের অগ্নি- সুরক্ষা বিভাগ দেখে। এখানে ওই বিভাগও নেই। হাওড়ায় রয়েছে। আর আমাদের কাছে দফতর থেকে ঘাটালের নার্সিংহোমগুলিতে প্রশিক্ষণের জন্য কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।”
দায় এড়ানোর এই ‘ঐতিহ্য’ চলছেই। আর তারই ফাঁকে ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে মানুষের প্রাণ। |