রাজ্যসভা ভোটে তাঁদের চার প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য সিপিএম-বিরোধী সমস্ত দলের কাছেই তাঁরা অনুরোধ জানাবেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সরকারের জোটশরিক কংগ্রেস আব্দুল মান্নানকে প্রার্থী দাঁড় করানোয় রাজ্যসভায় ভোট নিশ্চিত। সেই ভোটে তাঁদের চার প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতেই পার্থবাবু মঙ্গলবার বলেন, “বামফ্রন্টের বিরোধী সমস্ত বিধায়ককেই তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব। আমরা মোর্চা, নির্দল এবং এসইউসি বিধায়কদের সঙ্গেও কথা বলব।”
প্রসঙ্গত, পাহাড়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ইতিমধ্যেই রাজ্যসভা ভোট বয়কট করার কথা জানিয়েছে। মোর্চার তিন বিধায়ক রয়েছেন। উত্তরবঙ্গের কালচিনির আদিবাসী বিকাশ পরিষদের বিধায়কও মোর্চা-সমর্থিত নির্দল। তাঁরও ভোটে অংশ না-নেওয়ারই কথা।
এ দিন রাজ্যসভার ছ’জন প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র স্ক্রুটিনি হয়েছে বলে বিধানসভার সচিব তথা এই ভোটের রিটার্নিং অফিসার যাদবলাল চক্রবর্তী জানিয়েছেন। কাল, বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটে হল মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় সীমা। কিন্তু শাসকশিবিরের দুই শরিকের কারওরই সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কার্যত নেই।
তৃণমূল শিবিরে যেমন ‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা’, তেমনই বসে নেই কংগ্রেস শিবিরও। যে কারণে চতুর্থ আসনের জন্য দুই শরিকের লড়াই প্রায় সাধারণ নির্বাচনের চেহারা নিয়েছে। মান্নানকে জয়ী করার ‘রণকৌশল’ দলীয় বিধায়কদের বোঝাতে আগামী শুক্রবার কলকাতায় আসছেন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ। ওইদিন সন্ধ্যায় কিড স্ট্রিটের বিধায়ক আবাসে শাকিল দলীয় বিধায়ক ও প্রদেশের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। বৈঠকের পরে বিধায়কদের ‘নৈশভোজ’। ভোটে উপস্থিত থাকতে দলের বিধায়কদের উপর ‘হুইপ’ জারি করেছেন কংগ্রেস পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক অসিত মাল।
বিধায়কদের এক জনের ভোটও যাতে ‘নষ্ট’ না-হয়, সে জন্য দফায় দফায় বিধায়কদের নিয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। দলের প্রার্থী মান্নানকে জেতাতে সব বিধায়ককে একসঙ্গে নিয়ে ভোটপদ্ধতি, ভোটের অঙ্ক বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে। কী ভাবে ভোট দিতে হবে, কী কী পদ্ধতি মানলে ভোট ‘বৈধ’ বিবেচিত হবে, তা স্পষ্ট করতে ‘নকল’ ব্যালটে ভোট দেওয়ানো অভ্যাস করানো হবে তাঁদের। প্রথম দফায় ওই কাজ হবে শুক্রবার। ভোটের আগের দিন আরও এক বার ভোটপ্রক্রিয়া ঝালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই বৈঠকে দলীয় সাংসদ ও রাজ্যসভা ভোটে কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক তথা এআইসিসি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রামচন্দ্র কুন্তিয়ারও উপস্থিত থাকার কথা।
তবে কংগ্রেস বিধায়কদের প্রস্তাবিত নৈশভোজ নিয়ে এ দিন ‘কটাক্ষ’ করেছেন পার্থবাবু। তিনি বলেন, “আমাদের বিধায়কদের উপর দলীয় নেতৃত্বের আস্থা আছে। খাইয়ে-দাইয়ে বিধায়কদের আস্থা অর্জনের কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই। কংগ্রেসের এত ভয় কেন!” তবে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের এক নেতার কথায়, “ভয় তো পার্থবাবুরাই পাচ্ছেন। আমরা মান্নানকে প্রার্থী দাঁড় করানোয় ওঁরা ওঁদের চতুর্থ প্রার্থীর জয় নিয়ে চিন্তিত।” তৃণমূলের দুই প্রবীণ বিধায়ক অবশ্য জানিয়েছেন, বামেদের সমর্থন ছাড়া মান্নানের জয় অসম্ভব। তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান নেতা তথা মন্ত্রীর কথায়, “বামেদের সমর্থন নিয়ে ওরা জিতলে ভালই হবে। পঞ্চায়েত ভোটে এ রাজ্যে কংগ্রেস সাইনবোর্ড হয়ে যাবে!”
প্রসঙ্গত, অজিত ভুঁইয়ার মৃত্যুর পর তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা এখন ১৮৪। তাঁদের মধ্যে বাঁকুড়ার প্রবীণ বিধায়ক কাশীনাথ মিশ্র গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু এ দিন তিনি বিধানসভায় এসে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, তিনি ভোট দিতে আসবেনই। তৃণমূল সূত্রের খবর, ১৮৪ জন বিধায়কের ভোট দলের চার প্রার্থীকে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে, নাকি মুকুল রায়, কুণাল ঘোষ, নাদিমুল হকের জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট নিশ্চিত করার পর বাকি ভোট চতুর্থ প্রার্থী বিবেক গুপ্তকে দেওয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে কে কাকে ভোট দেবেন, তার তালিকা তৈরি করে বিধায়কদের জানিয়ে দেওয়া হবে। তারপর বিধায়কদের চারটি ‘গ্রুপ’ করে তাঁদের নকল ব্যালটে অন্তত তিনবার ভোটের মহড়া দেওয়ানো হবে। প্রত্যেক গ্রুপের বিধায়কদের আলাদা আলাদা রাখারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলের এক প্রবীণ বিধায়কের কথায়, “আমরা বিধায়কদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক হিসাবে তৈরি করছি। কারণ আমাদের অধিকাংশ বিধায়কই নতুন। রাজ্যসভার ভোট দেওয়ার পদ্ধতি, নিয়মকানুন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে অনেকেই সড়গড় নন। সেজন্য দলের অভিজ্ঞ বিধায়ক-সাংসদদের কাজে নামানো হয়েছে।”
এ দিন মনোনয়নপত্র স্ক্রুটিনির সময় তৃণমূলের প্রার্থী নাদিমুল রেলের যাত্রী পরিষেবা কমিটির সদস্য বলে বামফ্রন্ট অভিযোগ করে। বলা হয়, তিনি সরকারি সাম্মানিক অর্থ পান। অর্থাৎ তিনি ‘লাভজনক সংস্থা’র সঙ্গে জড়িত। অথচ তাঁর ‘এফিডেভিটে’ সে কথার উল্লেখ নেই। অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে শোভনদেববাবু জানান, নাদিমুল ভোটে প্রার্থী হওয়ার অনেক আগেই ওই পদে ইস্তফা দিয়েছেন। তাঁর ইস্তফা গৃহীতও হয়েছে। রাজ্যসভা ভোটের রিটার্নিং অফিসার যাদবলালবাবুও জানিয়ে দিয়েছেন, নাদিমুলের জমা দেওয়া মনোনয়ন পত্রের নথিতে কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। |