দেশীয় রাজনীতি কিছু কাল ধরিয়া ঘটনায় ঘনঘটাময়। তাহার মধ্যেই একটি বিষয় ঘটিয়া প্রায় বিস্মরণের পথে হাঁটিবার জোগাড়, যাহা কিন্তু ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুতর, ভবিষ্যতের জন্য তাহার স্মরণভাণ্ডারে সংরক্ষণ করিবার উপযুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের নতুন মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হইয়া চণ্ডীগড় ও লখনউ যাইবেন স্থির করিয়াও শেষে পরিকল্পনা বাতিল করিলেন। বাতিল করিলেন নিজ কর্মসূচির চাপেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ইউ পি এ সরকারও তাঁহার উপর প্রবল চাপ দিতেছিল এই সফর বাতিল করার জন্য। কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি মমতাকে হুমকিও পাঠাইয়াছিলেন। কংগ্রেসের আপত্তির কারণ বোঝা কঠিন নয়, দুই রাজ্যের নির্বাচনে বিজয়ী দল দুইটিই কংগ্রেস-বিরোধী, একটি তো সরাসরি এন ডি এ জোটের শরিক। এমনিতেই ইউ পি এ এখন মিত্রহীন, তাহার মধ্যে ইউ পি এ শরিক (এবং ঘটনাচক্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শরিক) তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এখন সেই কংগ্রেস-বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, তাহার অর্থ বা ব্যঞ্জনা লইয়া রাজনৈতিক মহলে বিষম শোরগোল পড়িবে, কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েরই বিপরীতে অন্যান্য দলকে একত্র করিয়া মমতা তৃতীয় ফ্রন্ট গড়িতে চাহিতেছেন, এই সিদ্ধান্ত হইবে ইহাই ছিল কংগ্রেসের আশঙ্কা। আশঙ্কার কিছু ভিত্তি থাকিতেই পারে, কিন্তু মমতার প্রতিযুক্তির ভিত্তিও অত্যন্ত সবল, স্পষ্ট। মমতার বক্তব্য: তৃতীয় ফ্রন্ট কিংবা জোট-রাজনীতির প্রশ্ন এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, তিনি কেবল একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিমন্ত্রণে সাড়া দিতেছিলেন। ইহার মধ্যে ‘রাজনীতি’ নাই, ইহা বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সৌহার্দ্যের প্রশ্ন।
মমতার এই অবস্থানটি প্রণিধানযোগ্য। তাঁহার সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে সমমর্যাদাপ্রসূত সৌহার্দ্য-সম্পর্কই থাকা স্বাভাবিক, তাহা আছেও। কোন রাজ্য সরকার দিল্লির শরিক, আর কোনটি বিরোধী, এই সব হিসাব সেই সৌহার্দ্যের প্রশ্নের সামনে অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যায়। এই যে ‘সৌহার্দ্য’, তাহাকে যদি তৃতীয় ফ্রন্ট অভিধা দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু ইহার চরিত্র অন্যান্য তৃতীয় ফ্রন্টের চরিত্র হইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ইহা প্রকাশ কারাট-নির্দেশিত তৃতীয় ফ্রন্ট নহে, যাহা মূলগত ভাবেই কংগ্রেস ও বিজেপি-র বিরোধী। বরং এই ফ্রন্টকে বলা যায় মুখ্যমন্ত্রীদের ফ্রন্ট। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারগুলির ফ্রন্ট। কংগ্রেস বা বিজেপি, কাহারও বিরুদ্ধতাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য নহে, মুখ্য উদ্দেশ্য হইল প্রয়োজনে কেন্দ্রের বিরোধিতার মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা। এখন যে ইউ পি এ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন, তাহা নিতান্তই আপতিক। ইউ পি এ নহে, দিল্লি নামক কেন্দ্রের বিপরীতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের একঠাঁই করাতেই মমতার উৎসাহ। এ হেন রাজ্যভিত্তিক ফ্রন্টের প্রয়োজন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য অত্যন্ত জরুরি। ফলে এক ভিন্ন অর্থে মমতার অবস্থান অবশ্য ‘রাজনৈতিক’। কিন্তু তাহা দলভিত্তিক রাজনীতি নহে, আরও বৃহত্তর এক কেন্দ্র-রাজ্য রাজনীতির প্রশ্ন। কেন্দ্রে কিংবা রাজ্যে যে দলই যখনই আসুক না কেন, এই বৃহত্তর রাজনৈতিক আবর্ত কিন্তু সর্বদাই ক্রিয়াশীল। ইহাও সত্য যে, ভারতের মূল দুটি দল কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই যে হেতু শক্তিশালী এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণায় আদ্যন্ত বিশ্বাসী, অনেক সময়েই রাজ্যভিত্তিক এই ফ্রন্টকে কংগ্রেস-বিরোধী বা বিজেপি-বিরোধী বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। কিন্তু বুঝিতে হইবে, ইহার মধ্যে দল-রাজনীতির অপেক্ষা বড় একটি রাজনীতি আছে, যাহা ব্যতীত কোনও যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি সম্ভব নয়, কেন্দ্র-রাজ্য রসায়নের মীমাংসা সম্ভব নয়। |