|
|
|
|
মমতাকে ফোন করে ইস্তফা দিলেন দীনেশ |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
অবশেষে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন দীনেশ ত্রিবেদী।
আজ বিকেলে দীনেশ ত্রিবেদী নিজেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে টেলিফোন করেন। মমতা তাঁকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, দলীয় নির্দেশ মেনে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। তখনই দীনেশ জানান, তিনি আজই ইস্তফা দিচ্ছেন। তবে তিনি পার্টির সঙ্গে থাকবেন বলেও দীনেশ জানান। মমতার সঙ্গে কথা বলার পরেই প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন দীনেশ।
দীনেশ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই দিল্লিতে সংসদীয় দলের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেই অনুযায়ী রাতেই তিনি দিল্লির বিমান ধরেন। কারণ দীনেশ ত্রিবেদীকে ইস্তফা দেওয়ানো নিয়ে কংগ্রেস তথা মনমোহন-সরকারের তরফে টালবাহানা চলছিল। রেল বাজেটে ভাড়া বাড়ানোর পরেই দীনেশকে রেলমন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে মমতা প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাক্স-বার্তা পাঠিয়েছিলেন। একই সঙ্গে নতুন রেলমন্ত্রী হিসেবে মুকুল রায়ের নাম প্রস্তাব করেন তিনি। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় টেলিফোন করে সাধারণ বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ জানান মমতাকে। তৃণমূল নেত্রী সেই অনুরোধ মেনেও নেন। শুক্রবার সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল মমতাকে ফোন করেন। তিনিও জানান যে, দীনেশকে ইস্তফা দেওয়ানো হবে। কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু শনিবারও দীনেশ ইস্তফা দেননি। কারণ, ‘মুখের কথায়’ তিনি ইস্তফা দেবেন না বলে জানিয়ে দেন।
|
|
রেল ও দেশের স্বার্থে যা করা উচিত ছিল, খুব ভাল
ভাবে সেটা করার চেষ্টা করেছি। দীনেশ ত্রিবেদী |
|
এই পরিস্থিতিতে ইউপিএ-সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দিল্লিতে সংসদীয় দলের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেন মমতা। কারণ তৃণমূল চাইছিল, সংসদে রেল বাজেট নিয়ে বিতর্ক শুরুর আগেই দীনেশকে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ানো হোক। সোমবার বেলা ১২টায় লোকসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে আলোচনার উপরে প্রধানমন্ত্রীর জবাবি ভাষণ রয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বের আশঙ্কা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর জবাবের পরে দীনেশ ত্রিবেদীকে সামনে রেখে রেল বাজেট নিয়ে বিতর্ক শুরু করে দিতে পারে সরকার। এর ফলে রেল বাজেট নিয়ে বিতর্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত দীনেশকেই মন্ত্রীর পদে রেখে দেওয়ার ‘অজুহাত’ খাড়া করতে পারবে কংগ্রেস। তৃণমূলের নেতারা মনে করছিলেন, এই ভাবে সময় কিনে সেই সময়টা সমাজবাদী পার্টির ইউপিএ’তে যোগ দেওয়া নিয়ে মুলায়মের সঙ্গে দর কষাকষির জন্য কাজে লাগাচ্ছে কংগ্রেস। তৃণমূলের একটা অংশ আবার বলছিলেন, প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, আহমেদ পটেল এবং মুলায়ম সিংহ যাদব মিলে চেষ্টা করছিলেন, যাতে দীনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা না দেন।
দীনেশকে সামনে রেখেই রেল বাজেট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেলে, ইউপিএ-সরকারের সঙ্গে সম্পর্কই তৃণমূলের সংসদীয় দলের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠত। সে ক্ষেত্রে মমতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হত, তৃণমূল সরকার থেকে বেরিয়ে আসবে, নাকি সমর্থন প্রত্যাহারের মতো চরম সিদ্ধান্ত নেবে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অবশ্য বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছিল, সোমবার লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পরে দেশের শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ নিয়ে আলোচনা হবে। রেল বাজেট নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে না। কিন্তু মমতাকে ‘কড়া অবস্থান’ নিতে দেখে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী দীনেশকে জানিয়ে দেন, তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।
কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন চাইছেন, দীনেশ ত্রিবেদী অধ্যায় এবং রাজ্যের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের যে ভাবে অবনতি হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে মমতা নিজে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসুন। কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, মুলায়ম সিংহ যাদব সরকারে যোগ না দিন বা না দিন, মমতাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রয়োজন হবে। তাই মমতাকে সরকারে রেখে আলাপ-আলোচনা করেই গোটা বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তৃণমূল সূত্রের খবর, আগামিকাল বেলা একটায় সংসদের সেন্ট্রাল হলে যাবেন মমতা। সেখানে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের নেতাদের কথাবার্তা হবে। এর পরে বেলা দু’টোয় তাঁর নেতৃত্বে সংসদীয় দলের বৈঠক বসবে। দীনেশ পদত্যাগ করলেও সংসদে ফরাক্কা বা রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে তৃণমূলের কী রণকৌশল হবে, তা নিয়ে সংসদীয় দলের বৈঠকে আলোচনা হবে। তৃণমূলের যুক্তি, তাদের দাবি মেনে কেন্দ্র এখনও রাজ্যের জন্য কিছুই করেনি। দার্জিলিঙের জন্য জিটিএ-বিলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতেও অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছে। বাজেট-বিতর্কে তৃণমূলের কোন নেতা কী ভাবে মুখ খুলবেন, তা নিয়ে আলোচনা হবে সংসদীয় দলে। |
|
বিমানবন্দরের পথে মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
এমনকী, দীনেশ পদত্যাগ করলেও এ বিষয়ে কংগ্রেস জোট-ধর্ম মেনে চলছিল না বলে তৃণমূলের অভিযোগ। এমন নয় যে, ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে এই প্রথম সরকারের কোনও শরিক দল তার কোনও মন্ত্রীকে প্রত্যাহার করাতে চাইছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের সময়ও শিবসেনা মন্ত্রিসভা থেকে সুরেশ প্রভুকে সরিয়ে নিয়েছিল। সুরেশের তাতে মত ছিল না। তিনি সে সময় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন। তৃণমূল নেতাদের যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গে মমতার মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের কে যোগ দেবেন, তা যেমন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়, তেমনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তৃণমূলের কোন প্রতিনিধি থাকবেন, কে থাকবেন না, তা ঠিক করার অধিকারও তৃণমূল নেত্রীরই। ঠিক সে কারণেই প্রণববাবুর পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়কে মমতা সরকারি পদে বসালেও কংগ্রেস তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
একই ভাবে মুকুল রায়কে রেলমন্ত্রী করার বিষয়েও কংগ্রেসের কোনও আপত্তি তোলা উচিত নয় বলে তৃণমূল নেতাদের যুক্তি। এর আগে মুকুলকে রেলমন্ত্রীর পদে বসানো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আপত্তি ছিল। তাই রেলের প্রতিমন্ত্রী হয়েও রেলমন্ত্রী হওয়া হয়নি তাঁর। এই সফরে মমতা আগামী তিন দিন দিল্লিতেই থাকবেন। এর মধ্যেই রেল মন্ত্রকে মুকুলের অভিষেক সেরে আসতে চাইছেন তিনি। সে ক্ষেত্রে এই তিন দিনের মধ্যেই মুকুলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়ে যেতে পারে। তবে রেল বাজেট নিয়ে বিতর্কের শেষে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও জবাবি বক্তৃতা দিতে পারেন বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর।
আজ মমতা দিল্লি রওনা হওয়ার আগেই দীনেশ তাঁকে ফোন করেন। দীনেশ জানান, “গত কয়েক দিন ধরে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে এক রকম কথা বলেছিলেন। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে টেলিফোন করে আর এক রকম কথা বলেন। আমি গোটা বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই কথা বলার সিদ্ধান্ত নিই।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের নেতারা তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলছেন বলে মমতার কাছে অসন্তোষ জানান দীনেশ। মমতাও জানান, দীনেশ যে ভাবে ভাড়া বাড়িয়ে রেলকে আইসিইউ থেকে বের করে আনার কথা বলেছেন, সেটাও দলীয় নীতির পরিপন্থী। দলের সিদ্ধান্ত কী, তা জানতে চান দীনেশ। মমতা
জানান, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে যে পদত্যাগ করতে হবে বলে জানিয়েছেন, তা-ই দলের সিদ্ধান্ত।
এর পরেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন দীনেশ। মমতা তত ক্ষণে কালীঘাটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছেন। সেখানেই দীনেশের কাছ থেকে খবর আসে, তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। মমতা অবশ্য বিদায়ী রেলমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ পুষে রাখছেন না তিনি। দীনেশ সংসদীয় দলের বৈঠকেও আসতে পারেন। আজ পদত্যাগের পরে দীনেশ বলেন, “তৃণমূল নেত্রী আমাকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ মেনে দলের সৈনিক হিসেবে আমি পদত্যাগ করছি।” তাঁকে রেলমন্ত্রীর পদে বসানোর জন্য তৃণমূল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তথা মনমোহন সিংহকে ‘ধন্যবাদও’ জানিয়েছেন দীনেশ। তবে একই সঙ্গে তাঁর যুক্তি, “রেলের স্বার্থে ও দেশের স্বার্থে যা করা উচিত ছিল, আমি খুব ভাল ভাবে সেটা করার চেষ্টা করেছি।” |
|
|
|
|
|