|
|
|
|
রক অ্যান্ড রোল,তার রাজপুত্র,আর রাংতা-দিন |
উন্মাদনার ইংরেজি কী? এলভিস প্রেসলি। কিংবা প্রথম সুপারস্টার, নিয়ম ভাঙা
আর পাগলামিও বলা যেতে পারে। কাল তাঁর জন্মদিন। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
মেমফিস।
এক দিন দুপুর। সান রেকর্ডস-এর স্টুডিয়ো। একটা ছেলে খুব ইতস্তত করে দরজা ঠেলে ঢুকল। তার পর অল্প তুতলে বলল, একটা গান রেকর্ড করা যাবে? মা’র জন্মদিন-উপহার। (যদিও সে দিনটা দু’মাস আগেই পেরিয়েছে, হাতখরচা জমেছে তো এখন!) সান রেকর্ডস-এর সর্বেসর্বা স্যাম ফিলিপ্স তখন স্টুডিয়োয় নেই, কিন্তু সহকারী মারিয়ন কেইসকার ছিলেন। তিনি ভ্যাবাচাকা ছেলেটাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ও হে ছোকরা, কার মতো গাও, তুমি?’ ছেলেটা ভেবে পেল না, কার মতো, বলল ‘কারও মতো না।’ মারিয়ন বুঝল, বেশি ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। চার ডলার দক্ষিণা নিয়ে স্টুডিয়োয় ঢুকিয়ে দিল।
না, এর পরই, ছেলেটা ভগবান হয়ে যায়নি। সে মুহূর্তের আগে এলভিস-এর জীবনে আসবেন স্যাম ফিলিপ্স। স্যাম ঠিক সোজা রাস্তায় হাঁটা পাবলিক ছিলেন না। মানে খারাপ কিছু না, জাস্ট চলতি হাওয়ার উল্টো ফুট-এ ভাসতে ভালবাসতেন। স্যাম তখন এ ঘাট সে ঘাট করে বেড়াচ্ছেন একটা ব্যতিক্রমী গলার খোঁজে। যে গলা হবে হয়তো কোনও ‘সাদা চামড়া’র, কিন্তু তা থেকে বেরোবে একটা ‘নিগ্রো’ মানুষের ঝাঁঝ। সেই আদিম ব্ল্যাক স্পিরিট। যে স্পিরিট পাওয়া যেত কিছু মার খাওয়া কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের গোঙানিতে। আমেরিকার সুনসান, অপরিচিত আবহাওয়ায় চাবুক খেতে খেতে ওরা শুধু গাইত, মনে করত ফেলে আসা ঘরবাড়ির কথা। সেটাই তো ‘ব্লুজ’। তেমনই তো গসপেল মিউজিক। আর না পেরে ঈশ্বরের কাছে হাউহাউ করে কান্না। যার ব্যথা নেই, তার গলা থেকে এ স্বর কিছুতেই বেরোবে না। |
এলভিস আবার ছোট থেকেই এমনই সব এলাকায় বড় হচ্ছিল। বাবা ভার্নন হদ্দ গরিব, মা গ্ল্যাদিস-ই টেনেটুনে সংসার চালাতেন। ওঁদের পাড়ায় ভরাভর্তি শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু সব্বাই প্রায় সমাজের পিরামিড-এর এক্কেবারে তলানি। মানে দেখতে এক, সম্মানে আর এক। পাড়ার চৌহদ্দি পেরিয়েই আবার কালো মানুষদের ভিড়। ছোট্ট এলভিস-এর খেলার বন্ধু ছিল ওই ভিড়। ফলে এলভিস-এর মনে শুরু থেকেই লেগে লেগে যাচ্ছিল, ওদের আদবকায়দা, ওদের ভাষা, ওদের গান, আর ওদের ওই স্পিরিট। সেই সব নিয়ে ভালই কাটত বিকেলগুলো, শুধু বাড়ি
ফেরার কম আলোয় বড্ড কষ্ট হত। মনে হত, আর একটু হাত ছড়িয়ে যদি থাকা যেত... কষ্টে আরও হাওয়া দিত পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া ট্রেন। পার হয়ে যাওয়া হুইসল সব সময় বেদনা দেয়। ঠিক অপরাজিত...
ফেরা যাক, সান রেকর্ডস-এর স্টুডিয়োয়। এলভিস-এর গান শুনে মারিয়ন তেমন একটা অভিভূত হননি বটে, কিন্তু কোথায় যেন মনে হয়েছিল, স্যাম এই গলাটা এক বার শুনুক। স্যাম শুনলেন, তার পর বললেন, আরও দেখতে হবে। স্যাম এলভিসকে স্টুডিয়োয় ডেকে বললেন, পছন্দের যা ইচ্ছে গাও। সঙ্গে জুড়ে দিলেন স্কটি মুর আর বিল ব্ল্যাককে, গিটার ও বেস-এ।
তিন জন মিলে অনেক ক্ষণ ধরে হিট সব গান গাইল, স্যাম-এর তাও মন ভরে না। স্যাম বুঝতে পারছিলেন, এদের দিয়েই হবে, কিন্তু সেই স্পার্ক এখনও আসছিল না। সেই স্পার্ক এল, যখন ওরা আর না পেরে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিল। এলভিস হঠাৎ তারস্বরে গেয়ে উঠল, ‘দ্যাট্স অল রাইট মামা...’ (বিখ্যাত গাইয়ে আর্থার ক্রুডাপ-এর একটি গান)। খেলার ছলেই স্কটি আর বিল সঙ্গত করতে লাগল। স্যাম হঠাৎই শুনতে পেলেন সেই আদিম বেদনা। পাশের ঘর থেকে উঁকি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আর এক বার হোক, একটু মন দিয়ে।’ এলভিস এ বার পেট থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দ্যাট্স অল রাইট মামা...’ ভেঙে পড়ার মুহূর্তে যেন নিজেই নিজেকে অভয় দিচ্ছে।
ব্যস, এর পর এক রাতেই আমেরিকা দুলে গেল। আর পৃথিবী পেল তার প্রথম সুপারস্টার। রেডিয়োর সব নব-ই তখন ওর স্বর খুঁজছে। মুশকিল হল, এলভিস এ সবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলে দেখতে দেখতেই নিজের রান্না করা উন্মাদনায় চোখ বুঝে ডুবে গেল। কথায় কথায় ক্যাডিল্যাক গাড়ি কিনে ফেলল, প্রায় প্রত্যেক শহরেই গার্লফ্রেন্ড পাতিয়ে ফেলল, হোয়াইট হাউস-এ গিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর ড্রয়ার পর্যন্ত ঘেঁটে তুলকালাম বাধাল। কারণ এ গ্রহে হিরো বলতে, আর কে-ই বা?
ওর শেষ জীবন টের পেয়েছিল, এই মাত্রাছাড়া কম্মের ফল। চাপ কমানোর বন্ধু হল ড্রাগ। মৃত্যুর কারণ। |
|
‘ব্লু হাওয়াই’ ছবিতে এলভিস প্রেসলি |
কিন্তু ধ্বংসের কাহিনি আজ থাক। আজ ভাবব না, কেন চার্চ ওর বিরুদ্ধে চলে গেল, কেন এফ বি আই সমাজের এক বড় বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করল ওকে, কেন ওকে মাঝরাতে বাবাকে ডাকতে হত, টিভি-র ছবি অ্যাডজাস্ট করতে। এলভিস-এর গল্প এই সবের সঙ্গে আরও অনেক কিছুরও।
যেমন একটা শক্ত আস্তরণ ভেঙে বেরনোর। যুদ্ধোত্তর আমেরিকায়, যখন সব্বাই লাইন মেনে হাঁটছে, তখন এলভিসই প্রথম লাইন ছেড়ে বেরল। আপাত সুগার-সুইট আবহাওয়া ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘রক অ্যান্ড রোল আমি শুরু করিনি, ঢের আগেই নিগ্রোভাই’রা করে গিয়েছে। ওরা ক্রেডিট পাবে না কেন?’
তার পর জাস্ট তুড়ি মেরে গোটা সংস্কৃতির রূপ পাল্টে দিল। টিনএজারদের হাতে হাতে চলে এল রেকর্ড প্লেয়ার, রেডিয়ো, গিটার। কখনও না দেখা একটা ইয়ুথ কালচার গড়ে উঠল, ওকে ধরে। আর স্টেজে দাঁড়িয়ে যখন এলভিস সমস্ত শরীরী পরিভাষা এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ওর আঙুল, পা আর গলা কাঁপাত, তখন হাজারো মেয়ে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করত ওর পায়ে। বিকট যৌন চাহিদা? হতে পারে, কিন্তু শুধুই গলার ভাব বদলে, অন্যের শরীরে যদি কেউ এমন রিঅ্যাকশন আনতে পারে, সে অবশ্যই স্পেশাল। শুনেছি, রেডিয়োয় এলভিস-এর স্বর শুনেই কত মহিলা আত্মহননের শেষ পা থেকে ফিরে এসেছিলেন। বেঁচেছিলেন আবার করে, তাজা হাওয়ায়। আর তাই বোধ হয়, কেউ কেউ এখনও এলভিসকে একলা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। ওনলি ভরসা যে। এখনও। |
|
|
|
|
|