মাটির মানুষ সকালে গামছা ফেরি,
রাতে সুরের কারবারি

বদ্বীপের পোড়ামাতলার নীতীশ রায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ট্রেনে গামছা ফেরি করেন। বছর ষাটেকের এমন একটি মানুষকে নিয়ে কারও আগ্রহ থাকাটা অস্বাভাবিক ঠেকবে যে কারও। তবে পিছনের কারণটা জানতে পারলে এই অস্বাভাবিক ঠেকাটা হয়তো ঠেকানো যাবে।
কী সেই কারণ?
সারাদিন এক ট্রেন থেকে আর এক ট্রেনে গামছা ফেরি করে ঘরের ফেরার পরে একেবারেই নিজের জগতে ডুব দেন নীতীশ। গণসঙ্গীত লেখা আর তাতে সুর বসানোর জগত। যে জগতে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী স্ত্রী।
এ ভাবেই পার করেছেন তিনটি দশক। নদিয়া জেলা ছাড়িয়ে ভিন জেলাতেও পৌঁছে গিয়েছে নীতিশের সুর। বিভিন্ন গণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নীতীশ গান লেখেন। শোষণহীন সমাজের স্বপ্নে বাংলার বিখ্যাত ছোটগল্পের নাট্যরূপ দেন, তা মঞ্চস্থ করেন স-দলে। আর সংসারের সুরাহার জন্য স্ত্রী সেলাইকলে জামা তৈরি করেন বাড়িতে।
বাস্তুচ্যুত হয়ে ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল ছেড়ে চলে আসা এ পার বাংলায়। নীতীশের জন্ম অবশ্য ফুলিয়ার পরের স্টেশন হবিবপুরের দেবীপুর গ্রামে। লেখাপড়া নবদ্বীপ কলেজে, প্রি-ইউনিভার্সিটি। আর পড়াশোনা এগোয়নি। বাবা ছেলেবেলাতেই নবদ্বীপে আসেন। গান, যাত্রাপালা, কথকথায় খ্যাতি ছিল দাদু কেদারচন্দ্র রায়ের। সেই সংস্কৃতি বয়ে নিয়ে চলেছেন নীতীশ। যদিও বিনোদনের আদিরূপ বদলে, গণচেতনাকে একত্রিত করার ভাবনা পেয়ে বসেছিল নীতীশকে। কিন্তু তারও আগে? “নবদ্বীপে শৈশবে মণিমেলা ছিল জমজমাট। স্কুলজীবনে ওই মণিমেলায় গানে, ছড়ায়, ড্রিল করায় যুক্ত হয়ে পড়ি। শান্তিদা অর্থাৎ শান্তিরঞ্জন দেব, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের, নেশা ধরিয়ে দেন। বলতে পারেন সময়ানুবর্তিতা, গঠনমুখী সুরই আমাকে এ পথে চালিয়েছিল।” দীর্ঘপথের বর্ণনা নীতিশের কথায়।
১৯৭৭ সাল থেকে গণসঙ্গীতের কণ্ঠে গলা মেলানো। সেই পথ ধরেই আইপিটিএ প্রীতি। শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরি, প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও প্রবীর বলের গানে। বন্দিমুক্তির গানে এসে পড়েছিল বিপুল চক্রবর্তীর গান। তখন নীতীশ ডাল-ভাতের খোঁজে পানিহাটির বাসন্তী কটন মিলের ‘বদলি’ শ্রমিক। কখনও বা বেলঘরিয়া-আগরপাড়ার ওরিয়েন্টাল মেশিনের অস্থায়ী শ্রমিক। জরুরি অবস্থার দাপটে স্বরলিপির খাতা, বইপত্র বন্ধুর গোয়ালের মাচায়। ‘বিহার প্রেস বিল’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, সদলে হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে। পথে নামেন কানোরিয়া জুটমিলের শ্রমিকদের জন্য। বিখ্যাত একটি গণসঙ্গীত,‘জন্মভূমি মা’।
সুর ও ঝঙ্কারে
ভাষার অলঙ্কারে
পাথরের বুকে ছেনির সোহাগে
তুলির আঁচড়ে
তোমাকে সাজাই মা
জন্মভূমি মা
শিল্পী, মোরা শিল্পী
মোরা শিল্পী সেনা।

কিন্তু কমিউনিস্টরা তো দেশকে ‘মা’ বলে সাধারণত সম্বোধন করতে চা না?
“আমি তা ভাবি না। এতে আমার কোনও দ্বিধা-জড়তা নেই,” জানালেন নীতীশ।
জীবনের স্মরণীয় ঘটনা ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিশাল বন্যা। এক হপ্তা হল বিয়ে হয়েছে। সব ফেলে, নীতীশ বন্ধুদের নিয়ে মুর্শিদাবাদের বর্ডারে। বন্যার্তদের পাশে। বাংলাদেশের রেডিওতে তখন বাজছিল,
‘ইসপানিয়া চা
সবার সেরা....’।

চা-এর বিজ্ঞাপনের সুর থেকে হঠাৎই গান, গুনগুনিয়ে। নৌকোর মাঝি, জলবন্দি মানুষেরা বললেন, পুরোটা গাইতে।
‘বন্যায় মোর ঘর ভাইস্যা যায
ভাসে মোদের আপনজন
বন্যা দিল কান্না চোখে
হইয়া রে দুশমন’।

“সমস্ত ক্যাম্পে রাত জেগে ওই গান গাওয়া। আজও ভেবে কূল পাই না, কোন ক্ষুধা আগে চলে? মন না পেট? সুর না অন্ন? নাকি দুটোই চলে সমান্তরাল,।” হাসলেন নীতীশ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.