পুস্তক পরিচয় ১...
‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’
কবিতা সমগ্র, খণ্ড ১ ও ২, ভাস্কর চক্রবর্তী। ভাষাবন্ধন প্রকাশনী, ২১০.০০ ও ২২৫.০০
ব ভাষাতেই এমন কবি বিরল, যাঁর কবিতায় একটি নতুন যুগ, তার নিজের ভাষায় কথা বলে ওঠে। ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫-২০০৫) সেই বিরল জাতের কবি। তাঁর কবিতায় বাঙালির নগরজীবন, অবশেষে তার নিজের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। যে কোনও কবির পক্ষেই এ এক বিরল কীর্তি, তাতে সন্দেহ কী। বর্তমান আলোচনা ভাস্করের সেই কীর্তিরই একটি মুগ্ধ ও সংক্ষিপ্ত অবলোকন। বস্তুতপক্ষে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার জন্মলগ্ন থেকেই জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখ কবির হাতে নাগরিক মানুষের সংকট ও শূন্যতার সঠিক অভিব্যক্তি রচনার চেষ্টার শুরু। পরবর্তী কালে শক্তি-শঙ্খ-সুনীল-উৎপল আদি পঞ্চাশের কবিদের কলমে সেই প্রয়াস তীব্রতর। কৃত্তিবাসী আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন এ দুয়েরই মিলিত অভীষ্ট ছিল কবিতায় নাগরিক কণ্ঠস্বরের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা। সব মিলিয়ে কবিতায় নগর-যন্ত্রণার ভাব জমছিল অনেক, কিন্তু ভাষাটা ঠিক ফুটছিল না। এমন সময়, বিশ শতকের ষাটের দশকে, ভাস্কর চক্রবর্তী নামের এক নতুন কবির কবিতায় হঠাৎ শোনা গেল এই সব আশ্চর্য উচ্চারণ,
‘হাস্যকর তোমার অতীত হাস্যকর তোমার ভবিষ্যৎ... ঘটনাহীন ঘটনাহীন মস্ত ঘটনাহীন তোমার জীবন
কফির কাপে, মিছেই তুমি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছো তোমার ব্যগ্র চামচ
তোমার মাথার ওপর চিরপুরাতন, সেই এক, পতনোন্মুখ চাঁদ
...এক শুয়োর এই সে দিন তোমাকে অপমান
করেছে, তোমার আত্মা, লম্বা জুতোর চেয়েও আরও লম্বা হয়ে গেছে হঠাৎ
...বছরের প্রথম দিনেও তুমি ঘুরে বেরিয়েছ একা একা
বছরের শেষ দিনেও তাই’

(‘দ্বিতীয় চিৎকার’, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা)। এই উচ্চারণের মাধ্যমেই, বাংলা কবিতায়, বিপন্ন-বিষণ্ণ নাগরিক মানুষের অথেনটিক কাব্যভাষার জন্ম হল। এই কাব্যভাষার আবিষ্কারই ভাস্করের কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। অতঃপর এই নবাবিষ্কৃত ভাষায় ভাস্কর লিখে চললেন আধুনিক মানুষের নৈঃসঙ্গ্য, বিষাদ ও শূন্যতাবোধের অমোঘ অকাট্য সব কবিতা। সেই কবিতা এক দিকে যেমন নগরজীবনের কান্না, স্তব্ধতা ও দীর্ঘশ্বাসের অবিকল ধ্বনিচিত্র; অন্য দিকে তেমনই সেই কবিতা নগরজীবনের ক্লেদ, গ্লানি ও হতাশার বিরুদ্ধে এক ক্ষুব্ধ কবিহৃদয়ের নিরন্তর গেরিলাযুদ্ধের মরিয়া রেড বুক।
গ্লানিময় ও অন্তঃসারশূন্য এই নগরজীবনের যথাযথ কাব্যরচনা করার জন্য এক দিকে ভাস্কর নিজের ‘রাস্তায়-ঘোরা’ জীবনকে একটা কবিতার গিনিপিগের মতো ব্যবহার করেছিলেন, অন্য দিকে এই কাব্যের যথাযথ আঙ্গিক-রচনার জন্য ভাস্কর তৈরি করেছিলেন তাঁর কবিতার ব্যক্তিগত ম্যানিফেস্টো, যাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কবিতার একটা লাইনের থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে কমপক্ষে একশো কিলোমিটার। কিন্তু, অদৃশ্য তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড় সম্পর্ক।’ এখানে অবশ্য তথ্যের খাতিরে একটা কথা বলতেই হবে যে, বাংলা কবিতায় আন্তর্জাতিক অনুপ্রেরণার ধারা বজায় রেখে, ভাস্করও, তাঁর এই কাব্যরীতির নির্মাণে, পাশ্চাত্যের অ্যান্টি-পোয়েট্রি আন্দোলন এবং বিশেষত তাদেউশ রুজেভিচ প্রমুখ কয়েকজন পূর্ব ইউরোপীয় কবিদের দ্বারা প্রাণিত হয়েছিলেন।
আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘আরবান অ্যাঙ্স্ট’ বলা হয়, বাংলা ভাষায় তারই শ্রেষ্ঠ কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। এই ‘তেলচিটে শহর’ কলকাতায় তিনি প্রশ্নে তোলেন, ‘ওগো বেঁচে আছি কি, বেঁচে আছি তো?... শুধু ফাঁকা ঘরে, চুপচাপ বেজে চলেছে রেডিও।’ শূন্য ঘরে রেডিয়ো বেজে যাওয়ার মতো নিরর্থক জীবন বেজে চলেছে এই শহরে। বিচ্ছিন্ন ও আত্মসর্বস্ব নাগরিক জীবনে
‘সমস্ত সম্পর্ক আজ
ভেঙে চুরে গ্যাছে
মনে হয়।’

এই জীবনে শুধুই প্রতিযোগিতার ইঁদুর-দৌড়, এখানে অপ্রেম আর একাকীত্বের অবসাদে ভারী হয়ে ওঠে মানুষের মন
‘প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে... যে-দিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভাল লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকবো’।

তাঁর চোখে, এই শহরেরও একটি চাঁদ আছে ‘কাগজের চাঁদ’ টাকা! এখানে ‘নিজের চোখের জল নিজেই দালাল হয়ে বিক্রি’ করেন তিনি। কী আছে তা হলে এখানে, এই জীবনে? তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’। তাঁর বিখ্যাত উক্তি!
এই নগর-যন্ত্রণার কবি বলেই সমালোচনার চেনা ছকে, ভাস্করকে এক জন আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিগত দুঃখ-বিষাদের কবি, নৈরাশ্যবাদী ও বাস্তববিমুখ কবি বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই ধারণা যে কত বড় ভুল, তা তাঁর কাব্যসমগ্র মন দিয়ে পাঠ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়। বিরাট ও বহুমুখী কবি ভাস্কর, কোনও স্টিরিয়োটাইপ-এ তাঁকে ধরা অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে, সংক্ষেপে তিনটি কথা বলা যেতে পারে। প্রথম কথা, ভাস্করের কবিতায় কোনও দার্শনিকতা নেই, বিশ্ববীক্ষা নেই, প্রতীকবাদ-অস্তিত্ববাদ-সুররিয়ালিজম আদি প্রথাগত কাব্যিকতার কোনও ‘ব্যাগেজ’ নেই। কলকাতা শহরের এক ‘রাস্তার ছেলে’-র সোজাসাপ্টা মুখের ভাষায় তার ভাঙাচোরা জীবনের কথাই ভাস্করের কবিতা। তা সত্ত্বেও সেই কবিতার বার বার দেখা দেয় দু’টি অপ্রত্যাশিত মেটাফর: ‘আত্মা’ এবং ‘ডানা’। এই দু’টিই আধুনিক কবিদের দ্বারা প্রায়-বাতিল শব্দ, অথচ ভাস্করের কবিতায় তাদের প্রগাঢ় উপস্থিতি:
‘আমার আত্মা
আজ ভোরবেলা থেকেই সেদ্ধ হচ্ছে আমার ঘরে
... কার্পেটের ওপর ভ্রমণ শেষে
কোন্ বাড়িতে এখন তামাকের জন্য হাঁক দিয়ে যাচ্ছেন বড়বাবু?
আমার আত্মা
গাদা-বন্দুকের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুক আজ’;
এ রকম আরও কত। আর ‘ডানা’?
‘ছড়াও তোমার ডানা আমি মুগ্ধচোখে দেখি তোমার বিস্তার’;
‘বাসগুলো ডানা মেলে উড়ছে শহরে’;
‘তারপর আবার একদিন ডানা জুড়ে দিলাম শরীরে
উড়তে শুরু করলাম।’

ভাস্করের স্ট্রিট-স্মার্ট কবিতার মধ্যে নিতান্ত বেমানান এই দু’টি কথার তাৎপর্য কী? তাৎপর্য এই যে, ভাস্করের কবিতায় ‘আত্মা’ কোনও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক নয়, মানবিকতার ডাকনাম। আর ‘ডানা’ সেই আত্মার, সেই মানবচেতনার, মুক্তির বাহক। এই দু’টি শব্দে বিধৃত রয়েছে নগরসভ্যতার সকল ডিহিউম্যানাইজেশন-এর বিরুদ্ধে মানবাত্মার অপরাজেয় উড়াল। স্পষ্টতই, ভাস্কর আত্মকেন্দ্রিক কবি নন, আত্মা-কেন্দ্রিক কবি।
দ্বিতীয় কথা, ভাস্করের কবিতায় নৈরাশ্যের অনন্ত ও অনুপুঙ্খ বর্ণনা, কিন্তু সেই বর্ণনা, প্রকৃত পক্ষে মানুষের আত্মার অসুখের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট। আত্মার অশ্রু আর রক্তের নিরন্তর বিষাদ-বীক্ষণ। রোগনির্ণয় একটিই: অপ্রেমের শূন্যতা। চিকিৎসা একটিই: ভালবাসা, আরও ভালবাসা।
‘মানুষ, মানুষের ভালবাসার জন্য
চিরকাল, পথের ওপর বসে বসে কাঁদবে’ এই বিশ্বাস।

এবং এই অসুখের প্রসঙ্গে এ কথাও বলার যে, ভাস্করের কবিতার আরেকটি প্রধান মেটাফর ‘বিষ’। তাঁর কত কবিতায় যে এই বিষের কথা ছড়ানো রয়েছে। ‘রক্তে বিষ মিশে আছে প্রিয়তমা।’; ‘ওস্তাদ, বিষ নেই এমন কোনো মানুষ, আমরা কি আর খুঁজে পাবো না শহরে?’; অর্থাৎ, ভাস্করের অসুখ-চেতনা, এক জন ডাক্তারের মতনই, সজাগ ও নির্লিপ্ত।
তৃতীয় এবং শেষ কথা এই যে, ভাস্কর এক জন আদ্যোপান্ত বাস্তবতার কবি। কলকাতার নগরজীবনের দুর্বিষহ বাস্তবতার যে তীক্ষ্ন ও মর্মস্পর্শী বিবরণ প্রায় জয়েসীয় দক্ষতায় লিপিবদ্ধ করেছেন ভাস্কর তাঁর সমগ্র কাব্য জুড়ে, বাংলা কবিতায় তার তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি কবিতা লিখতেই নেমেছেন কাব্যিকতার ধোঁয়াশা থেকে জীবনের বাস্তবতাকে ছেঁকে বার করার জন্য, সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি করেছেন তাঁর ‘জ্যান্ত ও অভিনব’ কাব্যভাষা, এবং আজীবন তাঁর এই ডাইরেক্ট পোয়েট্রি-র লক্ষ্য থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি। রাত্রির অন্ধকার ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের ফাঁকা জীবনের কথাই শুধু ভেবেছেন ও লিখেছেন। শহরের দমবন্ধ পরিবেশে, তাঁর মতো আর্বান কবিও অতি সহজেই স্মরণ করেছেন আবহমান বাঙালির রক্তে-মেশা মিস্টিক চেতনাকে,
‘আমি চাই আমার কবিতা বাউলগানের মতো বিশাল আর খোলামেলা হয়ে উঠুক
একটু নিঃশ্বাস ফেলুক সহজে।’

এ কারণে ভাস্করকে, পশ্চিমী অর্থে, শুধুমাত্র এলিয়েনেশন আর অবসাদের কবি বলা যাবে না কিছুতেই। বরং নিজের আত্মপরিচয়ের মৌলিকতায়, তিনি অত্যন্ত নির্দিষ্ট ভাবে, কলকাতা শহরের এক ‘রাস্তার ছেলে’-র জ্যান্ত ও যুদ্ধরত জীবনবোধের কবি। এবং একই সঙ্গে, তিনি আবহমান নগরজীবনের দ্রষ্টা কবি। বস্তুতপক্ষে ভাস্করের কবিতা পাঠককে ‘বেঁচে থাকবার মতো নির্জন সাহস’-ই জোগায়।
আলোচ্য দুই খণ্ডের কবিতা সমগ্র-তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভাস্কর চক্রবর্তীর নয়টি কাব্যগ্রন্থের সব ক’টি কবিতা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহু অপ্রকাশিত কবিতা, অনুবাদ কবিতা, দুই খণ্ডের ভূমিকা রূপে ব্যবহৃত ভাস্করের দু’টি কবিতা-বিষয়ক অনুপম গদ্য এবং সবশেষে একটি তথ্যবহুল ও মূল্যবান গ্রন্থপরিচয়। সব মিলিয়ে এই অতীব সুসম্পাদিত ও সুমুদ্রিত সংকলন প্রকাশের জন্য সম্পাদক সুমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং প্রকাশকের ভূয়সী প্রশংসা প্রাপ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.