চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
নিবিড় মেলবন্ধন ঘটে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার
নারায়ণ সিংহ একজন তরুণ স্বশিক্ষিত শিল্পী। স্ক্র্যাপমেটাল স্কাল্পচার বা বিভিন্ন পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ জুড়ে ভাস্কর্য করে আসছেন অনেক দিন থেকে। কলকাতায় তাঁর কয়েকটি একক প্রদশর্নীও হয়েছে। সম্প্রতি হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট গ্যালারিতে ‘দেবী’ শিরোনামে তাঁর ভাস্কর্য ইনস্টলেশন ও ড্রয়িং-এর যে একক প্রদর্শনী হল অভিনবত্বের দিক থেকে তা নিঃসন্দেহে অসামান্য। উত্তর-আধুনিকতার দর্শন ও বিশ্বায়ন-সঞ্জাত আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও রূপভাবনাকে কী ভাবে মিলিয়ে নেওয়া যায়, তার আদর্শ উপস্থাপনার দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনী।
বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার নানা ঢেউ আমাদের দেশের সাম্প্রতিক দৃশ্যকলায় এখন বহুমুখী অভিঘাত সৃষ্টি করছে। অনেক শিল্পী নানা রকম চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। আন্তর্জাতিকতাই এখানে প্রধান উপজীব্য। ঐতিহ্যের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। জাতীয় ঐতিহ্যের ভাবনা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকতা বলতে অবশ্য সবটাই পাশ্চাত্যের অনুকরণ। এ কারণে যে বিপুল কাজ হচ্ছে এখন দৃশ্যকলার নানা ক্ষেত্রে, তার অনেকটাই খুব আরোপিত মনে হয়। অনেক সময়ই তা হয়ে ওঠে বিদেশের নকল। দেশগত আত্মপরিচয় থাকে না কিছু। থাকে না প্রাণের স্পন্দন। মেধার প্রাবল্যে মনন আবৃত হয়ে যায়।
এ রকম পরিস্থিতিতে আলোচ্য প্রদর্শনীটি যেন নতুন আলোর সন্ধান দেয়। দেখায় জাতীয়তা থেকেই জেগে উঠতে পারে আন্তর্জাতিকতা। এখানে যে নির্মাণপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভাবেই পাশ্চাত্য প্রযুক্তি ভিত্তিক। সেটাকে আত্মস্থ করেই সমগ্র পরিমণ্ডলে আনা হয়েছে ঐতিহ্যের বাতাবরণ। আন্তর্জাতিকতার আঙ্গিকে কাজ করতে করতে শিল্পী যে ভাবে দেশীয় লৌকিক চেতনা ও আধ্যাত্মিকতাকে উন্মীলিত করেছেন, তাতেই প্রদর্শনীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শিল্পী: নারায়ণ সিংহ
এই প্রদর্শনীর প্রকল্পের মূল বিষয় দেবী দুর্গা ও শারোদোৎসবের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল। গ্যালারির পাঁচটি কক্ষ আলাদা আলাদা ভাবে ছোট বড় নানা আকৃতির ভাস্কর্য, ড্রয়িং, আলোকচিত্র ও ইনস্টলেশনে সাজানো হয়েছে। অধিকাংশ ভাস্কর্যেই দেবী দুর্গা ও আনুষঙ্গিক প্রতিমাকল্পের উপস্থাপনা। কিন্তু পুজোর সঙ্গে তো গভীর ভাবে সম্পৃক্ত থাকে জীবন। তাই জীবনের নানা অনুষঙ্গকেও শিল্পী সাজিয়েছেন দেবীমূর্তির পাশাপাশি। তাতে পুরাণকল্প ও প্রবহমান জীবনের মধ্যে নিবিড় এক সংযোগ গড়ে উঠেছে। এই সংযোগের মধ্য দিয়েই প্রদর্শনীটি অতীত ও সাম্প্রতিক, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তোলে।
দুর্গা প্রতিমার অনেক বড় মাপের ভাস্কর্য রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। সেগুলি নির্মিত হয়েছে নানা পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ও বাঙালির ঘরে বা পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত নানা রকম ধাতব ওয়েল্ডিং বা ফ্যাব্রিকেশনের বিভিন্ন পদ্ধতিতে জুড়ে জুড়ে। এই নির্মাণপদ্ধতিতে যন্ত্রাংশ যেমন নান্দনিক সৌন্দর্যে উন্নীত হচ্ছে, তেমন সাধারণ আসবাব বা তৈজসপত্রও তাদের স্বাভাবিক নান্দনিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর এক যান্ত্রিকতায় অংশগ্রহণ করছে। নির্মাণপদ্ধতির ভিতর ভাব ও ভাবনার এই যে দ্বিমুখী সঞ্চরণ, এটা এই শিল্প প্রকল্পের বিশেষ একটি দিক। প্রদর্শনীর আবহে বাজছে ঢাক ও কাঁসরের মৃদু বাজনা, যা পুজোর পরিমণ্ডল মনে পড়িয়ে দেয়। রয়েছে গ্রামের দরিদ্র বালক, বালিকারা। পুজোর আনন্দ যাদের অনির্বচনীয় করে তোলে। গণেশের মুখোশ পরে কেউ লুকোচুরি খেলছে। কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে চায়ের কেটলি হাতে। প্রতিমার পাশেও বসে আছে কেউ। যন্ত্রাংশ সংযোজনেই তৈরি হয়েছে তারাও। এর পাশাপাশি প্রদর্শনীর আর একটি অভিনব দিক ইনস্টলেশন। পুজোয় বা গৃহস্থের দৈনন্দিনতায় ব্যবহৃত কাঁসা বা পিতলের অজস্র ছোট বড় থালা দেয়ালে সাজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ইনস্টলেশন। আর একটি ইনস্টলেশনে সাজানো হয়েছে পুজোয় ব্যবহৃত ধুতি-কাপড়। দৈনন্দিনতাকে নান্দনিক বৈভবে উত্তীর্ণ করা শিল্পের একটি বড় দায়। এখানে শিল্পী সেই কাজটি নিষ্ঠাভরে করেছেন। পরিশেষে বিসর্জন। শূন্য চালচিত্র দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি বালিকা দেবীর মুকুটখানি নিজের মাথায় ধারণ করে তাকিয়ে আছে। সম্ভ্রান্ত অতীত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.