সাল ১৫১০। চৈতন্যদেব তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণের বারো দিনের মাথায় ফিরেছেন শান্তিপুরে। হাওয়ার বেগে ছড়িয়েছে খবর। হাজার হাজার মানুষ পাগলের মত ছুটছেন, সেখানেই নদীর ঘাটে লোক ভেঙে পড়েছে। নৌকা না পেয়ে সাঁতরে ভেলা তৈরি করে যে যে ভাবে পারছেন, নদী পার হচ্ছেন।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে লিখছেন, “অনন্ত অর্বুদ লোক হৈল খেয়াঘাটে, খেয়ারি করিতে পার পড়িল সঙ্কটে, কেহ বান্ধে ভেলা কেহ ঘট বুকে করে, কেহ বা কলার গাছ ধরিয়া সাঁতরে।” কিন্তু প্রশ্ন হল, এ কোন নদী? পণ্ডিতদের মত হল, গঙ্গা অর্থাৎ ভাগিরথী সেই সময়ে নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত। ভেনডেন ব্রুক ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মানচিত্রে দেখিয়েছেন, সেই সময়ে নবদ্বীপ এবং শান্তিপুর এই দুই জনপদই ছিল ভাগিরথীর পূর্ব পারে। সেক্ষেত্রে নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর যেতে গঙ্গা পার হওয়ার দরকার নেই। তাহলে এ কোন নদী? গবেষকেরা বলছেন, পঞ্চদশ শতকের সেই নদী কী জলঙ্গি বা চলতি নামে খড়ে? যাকে ভেনডেন ব্রুক তাঁর লেখায় দ্য গলগ্যাটসি স্প্রুইস বলেছেন।
আদ্যন্ত নদিয়ার নদী জলঙ্গি ছিল নদিয়ার প্রধান বাণিজ্য পথ আর সেটাই তার কাল হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা নদীর বাঁক ছেঁটে বাণিজ্যপথ আরও প্রশস্ত করতে নদীর মৃত্যুর পথটাই বেশ কিছুটা প্রশস্ত করে দিয়েছিল। মানুষের লোভ আর প্রশাসকের উদাসীনতা এই দুইয়ে মিলে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে বসেছে জলঙ্গি নদী। যার মূল দৈর্ঘ্য ২২০.৫ কিমি, যার মধ্যে ৪৮ কিমি আজ আর নেই। কোথাও চাষের জমি তো কোথাও রাজ্যসড়ক খেয়ে ফেলেছে জলঙ্গিকে। অবশিষ্ট ১৭২.৫ কিমিও বড় বিপন্ন। বিশেষ করে ইটভাটা, মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, উন্নয়নমূলক নির্মাণ এবং অত্যধিক পরিমাণে নদী থেকে জল তুলে নেওয়া--এইসবের কারণে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে জলঙ্গি বা খড়ে। আর নদীর সেই বিপন্ন মুমূর্ষুতার ইতিহাস দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছেন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক বলাইচন্দ্র দাস। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ আয়োজিত ১৮তম ইতিহাস-পুরাতত্ত্ব-লোকসংস্কৃতির সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান বক্তা হিসাবে বলাইবাবু প্রায় দুই ঘন্টা ধরে শোনালেন জলঙ্গি নদীর সেই বিস্ফোরক কাহিনী।
করিমপুরের উত্তরের চর মধুবোনায় উপন্ন হয়ে নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জে গঙ্গায় মিশেছে জলঙ্গি। এই পথটুকুর দৈর্ঘ্য ২২০.৫ কিমি। কিন্তু মধুবোনা থেকে মোক্তারপুর এই ৪৮ কিমিতে কোথাও জলঙ্গির অস্তিত্ব নেই। বেশিরভাগ জায়গায় নদী এখন চাষের মাঠ যে মাঠে দাঁড়িয়ে চাষিরা নির্বিকারভাবে বলেন, “এখানে আবার জলঙ্গি কোথায়? কোনওদিন ছিলও না জলঙ্গি তো ওই ধারে।” আবার করিমপুর জলঙ্গি রোড নির্মাণ করতে ১৯৫৬ সালে মুছে দেওয়া হয় ওই এলাকায় জলঙ্গির অস্তিত্বই। মোক্তারপুরের পর থেকে নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জ পর্যন্ত জলঙ্গির অবস্থা বড় করুণ। মোক্তারপুরে ভৈরব মিশেছে জলঙ্গিতে। তারই বয়ে আনা জল কোনওরকমে বাঁচিয়ে রেখেছে ‘শুখা’ জলঙ্গিকে। ভৈরবের যে উৎস সেই পদ্মাও তো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। ফলে জলঙ্গির জল ক্রমশ কমছে এভাবে বেঁচে থাকা বড় অসম্মানের। তেমনই দুটি নজির শোনালেন বলাইবাবু। করিমপুর তেহট্ট অঞ্চলের হিন্দিভাষীরা ছট পুজোর সময় জলঙ্গির পারেই যাবতীয় ধর্মীয় আচরণ পালন করতেন কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তাঁরা জলঙ্গির বদলে বেছে নিয়েছেন মুর্শিদাবাদের পদ্মাকে। অন্য দিকে, পন্ডিতপুরের জেলেপাড়ার মৎস্যজীবীরা দশহরার দিন জলঙ্গি নদীতে একটি সাড়ম্বর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে নদী পুজো করতেন। আজ ওঁরা নদী পুজো করতে আসেন। নবদ্বীপের গঙ্গায় মৎসজীবীদের কথায়, “নদী কোথায়, খড়ে তো এখন বদ্ধ নালা হয়ে গিয়েছে।”
জলঙ্গিকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার এক চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে বলাইবাবু জানালেন, তেহট্টের এক খেয়াঘাট মালিক রীতিমত গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন প্রতি শুখা মরসুমে তিনি নদীগর্ভে ৭০ ট্রাক বোঝাই মাটি ফেলেন। ফলে নদীর দুটি পারের ব্যবধান অনেকটাই কমে আসে আর সেই সংকীর্ণ নদীর বুকে চার পাঁচটি নৌকা পাশাপাশি বেঁধে দিয়ে তার উপর কাঠের পাটাতন ফেলে মানুষজন, গাড়ি ঘোড়া যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। সবার চোখের সামনেই এই ঘটনা ঘটছে বছরের পর বছর। কেউ প্রতিবাদ করেন না, শুধু তাই নয়, বিভিন্ন মৎস্য সমবায় সমিতিকে অর্থের বিনিময়ে লিজ দিয়ে দেওয়া হয় মাইলের পর মাইল জলঙ্গি নদী। আর নদীর বুকে ‘কাঁটা’ দিয়ে মাছ চাষ করে মুনাফার ব্যবস্থা হয়। আর দমবন্ধ হয়ে একটু একটু করে মরে যায় নদী।
এই মূহূর্তে জলঙ্গির জলের উৎস ভৈরব ছাড়াও শেয়ালমারি, সুতিনালা এবং কলমাখাল। অন্য দিকে, ভরা মরসুমের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাবার পথ ছোট ভৈরব বা ভৈরব খাল, কেষ্ট রায়ের খাল, সরস্বতী খাল এবং চতুর্থ যে পথটি ছিল, অঞ্জনা নদী সে নিজেই এখন মৃত। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পিতামহ রুদ্র রায়ের আমলে অঞ্জনার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নদিয়া মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের নদ নদীগুলি প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা বিপন্ন তার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষমতায় পুষ্ট মানুষের নদীর প্রতি ব্যবহার সমস্ত যুক্তির সীমা লঙ্ঘন করেছে ফলে নদী আশীর্বাদের মুদ্রার বদলে ভয়ের তর্জনী তুলেছে।
জলঙ্গির এভাবে মজে যাওয়া এই বাংলার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। জলঙ্গির দুপাশে বাংলার বৃহত্তম গৌণ ধর্মালম্বীদের বাস। নদী চলে গেলে বিপন্ন হবেন তাঁরাও। যেমন পাঁচ পুরুষের মাছ ধরার পেশা হারিয়ে জাল ছেড়ে রিকশার হ্যান্ডেল বা মজুরের কোদাল, কাস্তে ধরেছেন হাজার হাজার মৎস্যজীবী কেননা মূমূর্ষু এক নদীকে ধরে জীবন নদীর নৌকা যে আর বেশিদিন বাওয়া যাবে না, তা বেশ বুঝেছেন ওরাও। তাই নিঃশব্দে মৃত্যুর পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে নিঃসঙ্গ জলঙ্গি। |