প্রণবের চেষ্টায় ইয়েমেনে মুক্ত বাঙালি বিজ্ঞানী
রাত বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ত আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। পরের ভোরটা আসবে তো? নাকি ‘দরকষাকষি’ মাঝপথে থেমে যাবে, আর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসবে বাইরের অতন্দ্র এ কে-৪৭ থেকে?
অন্ধকারে ইতি টেনে অবশেষে নতুন ভোর হল খড়্গপুর আইআইটি-র প্রাক্তন ছাত্র, ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী সুকুমার রায়চৌধুরীর। তেল তোলার কাজে ইয়েমেনে গিয়ে সেখানকার দস্যুদের হাতে অপহৃত হয়েছিলেন তিনি। তার পর প্রায় দশ দিন বন্দি থাকার পর গত কাল সন্ধ্যায় মুক্তি পেয়েছেন। রাজধানী সানা থেকে আন্দাজ একশো কিলোমিটার দূরে এক অজ্ঞাত, পাণ্ডববর্জিত টিলার উপর একটি ছোট্ট ঘরে নরকবাস শেষে।
“নরক ছাড়া আর কিছুই নয়।” সুকুমারবাবুর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সেই ত্রাসের স্মৃতি এখনও যথেষ্ট দগদগে হয়ে রয়েছে তাঁর স্নায়ুতে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায়, বিদেশ মন্ত্রকের সহযোগিতা এবং তেল সংস্থার মোটা অর্থদণ্ডের পর অপহরণকারীরা তাঁকে ফেরত পাঠিয়েছে সানায়। আপাতত তিনি সেখানকার একটি পাঁচতারা হোটেলে রয়েছেন। চেষ্টা চলছে বাকি আইনি নিয়মরক্ষাগুলি সেরে দ্রুত দেশে ফেরার। দূরভাষে জানালেন, “গায়ের কোট খুলে শুতাম। বাথরুমের জন্যও ওরা সহজে বাইরে যেতে দিত না। সে এক পূতিগন্ধময় পরিস্থিতি।”
সুকুমার রায়চৌধুরী
‘ওরা’ অর্থাৎ সানার কুখ্যাত অপহরণকারী হুসেন এবং তার দলবল। বিদেশি নাগরিকদের অপহরণ করে মোটা মুক্তিপণ আদায় করাটা এদের পেশা। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম। রয়েছে আন্তর্জাতিক অপহরণ চক্রের সঙ্গে যোগসাজশও। রাজধানী সানার নিকটবর্তী পাহাড়, মরুভূমিতে আস্তানা গেড়ে স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় ‘কাজ সারাটা’ যাদের কাছে জলভাত। সুকুমারবাবুর কথায়, “এই দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য প্রবল। সরকারের কর্তৃত্ব কম, পরিকাঠামো বলতে কিছুই নেই। দারিদ্রও ভয়াবহ। আমরা ধারণা, এই কারণে অপরাধপ্রবণতাও বাড়ার সুযোগ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের মাধ্যমে টাকাও আসছে।”
ফরিদাবাদের একটি বেসরকারি তেল ও গ্যাস উত্তোলন সংস্থায় চাকরিরত মুর্শিদাবাদের ছেলে সুকুমার রায়চৌধুরী গত পঁচিশ বছর ধরে দিল্লির বাসিন্দা। কর্মসূত্রে ঘুরতে হয় গোটা বিশ্ব। কিন্তু ইয়েমেনের একটি বেসরকারি তেল সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করতে ডিসেম্বরের গোড়ায় ইয়েমেন যাত্রার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, কী অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। গত ৮ তারিখ সন্ধ্যাবেলা দিল্লিতে তাঁর স্ত্রী অনিতা রায়চৌধুরী প্রথম ফোনটা পান (সুকুমারবাবুকে আগাগোড়া ফোন ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল অপহরণকারীরা)। কাঁপা কাঁপা গলায় সে দিন সুকুমারবাবু শুধু বলতে পেরেছিলেন, তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। সানা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে ‘সাইট’-এ যাওয়ার পথে কোনও এক পাহাড়ি জায়গায় তাঁদের গাড়ি দাঁড় করায় সশস্ত্র বাহিনী। তার পর তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এমন একটি টিলায়, যেখানে বসতি বলতে ওই একটিমাত্র ঘরওয়ালা বাড়ি। বিদ্যুৎ নেই। জল নেই। শৌচাগারও নামে মাত্র। চারদিক ধু ধু করছে। বাইরে ২৪ ঘণ্টার পাহারাদারি। সুকুমারবাবুর সঙ্গে ছিলেন কাজাখস্তানের আরও তিন জন ইঞ্জিনিয়ার। দোভাষীর মাধ্যমে বন্দিদের সঙ্গে কথা চালাত হুসেন ও তার সঙ্গীরা। সকাল বিকেল পাঠাত জলের বোতল, রাজমা সেদ্ধ এবং বিরাট একটি রুটি (ইয়েমেনে এমন রুটি বহুল প্রচলিত, যা অনায়াসে পাঁচ জন ভাগ করে খেতে পারে)। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে সেই খাবারই মুখে তুলতেন সুকুমারবাবু। মূত্রত্যাগের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি করে বোতল। শোওয়া, মাটিতে কোট পেতে। একবস্ত্রে দিনের পর দিন।
দু’দিন কাটার পর হুসেনের তরফ থেকে তাঁদের জানানো হয়, প্রায় দশ কোটি টাকার মুক্তিপণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির (ইয়েমেনের) কাছে চাওয়া হচ্ছে। টাকা পেলেই ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিরন্তর সাবধানবানী, ফোন করতে চাও করো। কিন্তু পালানোর চেষ্টা করলে মৃত্যু অনিবার্য। সুকুমারবাবুর কথায়, “শেষ দিকে মানসিক যন্ত্রণা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল এক বার অন্তত পালানোর চেষ্টা করি। গুলি করলে করুক। এই অবস্থার থেকে তো অন্তত মুক্তি ঘটবে।”
প্রতিটা দিন শুরু হত মুক্তির অপেক্ষা নিয়ে। শেষ হত হতাশায়। শরীরও আর বইছিল না। এরই মধ্যে তাঁর স্ত্রী অনিতাদেবী দেখা করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরিস্থিতি খুলে বলেন। প্রণববাবু অবিলম্বে বিদেশ মন্ত্রককে বিষয়টি জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে সক্রিয় হয় সাউথ ব্লক। ইয়েমেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আসাফ সইদ নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন অনিতাদেবীর সঙ্গে। পরোক্ষে সব রকম সহায়তা করা এবং ইয়েমেন সরকারের উপর চাপ দেওয়ার কাজটি করলেও, সরাসরি বিষয়টি নিজেদের হাতে নিতে চায়নি বিদেশ মন্ত্রক। তার কারণ, তা হলে জটিলতা বাড়তে পারে। ভারত সরকার পিছনে আছে জানলে অপহরণকারীদের চাহিদাও বেড়ে যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি টাকায় রফা হয়। সেই অর্থ অপহরণকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার পরে ছাড়া পান সুকুমারবাবু। বললেন, “হঠাৎ শেষ দিন সকালে আমাদের শ্যাম্পু দেওয়া হল। ঘাবড়ে গিয়ে ভাবলাম, ব্যাপার কী! খতম করার আগে বিশেষ খাতিরদারি নাকি! কিন্তু না। হুসেন সবাইকে হাজির করল ঘরের সামনে উঠোনে। তার পর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিল। যার মোদ্দা বক্তব্য, আমরা খুবই ভাগ্যবান। কারণ, আমাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যে পরিমাণ অর্থ চাওয়া হয়েছিল, তা না পাওয়া সত্ত্বেও।” এর পরে গাড়িতে চাপিয়ে সুকুমারবাবুদের সানা শহরে ছেড়ে দিয়ে যায় তারা।
এমন দুর্লভ অভিজ্ঞতা, অথচ মোবাইল ক্যামেরায় একটাও ছবি তুললেন না কেন সুকুমারবাবু? বললেন, “প্রাণের ভয়ে।” এক দিন চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাইফেলের খোঁচা খেতে হয় তৎক্ষণাৎ। সে দিনই বুঝেছিলেন, ওই ঘরে দেওয়ালেরও চোখ আছে। তাঁকে বলা হয়েছিল, ছবি তোলার চেষ্টা করলেই প্রাণ যাবে। তাই আর ঝুঁকি নেননি তিনি।
ক্যামেরায় ছবি না উঠুক বা না উঠুক, বাকি জীবনটা যে তাঁর এই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি থেকে মুক্তি নেই, তা কিন্তু হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছেন এই বঙ্গসন্তান!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.