দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে আসেননি। অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক
মানচিত্রকে রঙিন করে তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
গলায় কণ্ঠী, কপালে রসকলি, ভাবে কৃষ্ণকথা, অ-ভাবে রাধা নামএই হল ভক্ত-জন-কথা। এমনটাই বলেছিলেন চাঁপাডাঙা আরামবাগের পথে, সোদপুরের কাঁড়িগলির (তালগাছের খুঁটি) গড়ানে বসত, কীর্তনীয়া অনিলকুমার মণ্ডল। গত বিধানসভা নির্বাচনের দিন, তপ্ত দুপুরে সমগ্র এলাকার লাইন হোটেল খুঁজে ব্যর্থ হয়ে, কাঁড়িগলির রাস্তার হোটেল হয়ে উঠল অন্নপূর্ণার পাকশালা।
ক্ষুন্নিবৃত্তি মিটিয়ে ভাবছি, রাতে পাত পাড়ব কোথায়?
হঠাৎ আবির্ভাব এই রসকলির। মানুষটির করজোড়ে নিবেদন, “গৌর-নিতাই। আমার বাড়িতে রাতে যদি সেবা নেন।” উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকলেন। ফলে, রাতের রুটির সঙ্গে অতিরিক্ত ‘মহাজনী’ পদ, অসংখ্য কীর্তন-কলি। মধ্যে, কীর্তনের ভাব-রস-পদ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। আমি বিনীত শ্রোতা মাত্র।
জানা গেল, নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের ঘটনার পর অনিল ‘গণজনী’ পদে বেঁধেছিলেন ‘দুই বিঘা জমি’। যেখানে যেখানে পালা গেয়েছেন, সেখানের কমরেডরা বিরক্ত-বিব্রত এবং অতি উৎসাহী কেউ কেউ এই বিশেষ কীর্তন বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। বলা অতি-বাহুল্য, ব্যর্থ হয়েছিলেন অতি-উদ্যোগী কমরেডরা। কারণ, পল্লির কীর্তন-প্রাণ জনতার বিপুল আগ্রহ ছিল, এখনও আছে, ‘দুই বিঘা জমি’-র পালায়। সঙ্গে মিশেছিল কমিউনিস্ট কীর্তনীয়ার জেদ! ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন সঙ্গী কমরেডদের। কী ব্যাখ্যা?
“রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘দুই বিঘা জমি’-র উপেন ও বাবুর সম্পর্ক, জমির মালিক ও কৃষকের জমি হারানোর ক্রিয়া, যুগ যুগ ধরে সত্য। এমনকী এ কবিতা লেখার আগেও। ভবিষ্যতেও এই সমস্যা থাকবে। এই কীর্তন সার্ধ শতবর্ষে কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর দীক্ষার পাঁচশো বছর উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি।” বিনয়ের সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ের মিশেল উঠে এল কীর্তনীয়া অনিলের গলায়।
কিন্তু আপনি তো ‘দুই বিঘা জমি’-তে বাখান-ব্যাখ্যা দেন না। যা মহাজনী পদ-এ কীর্তনের মাঝে মাঝে গায়কেরা দিতেন।
“ঠিক ধরেছেন। চৈতন্য জীবনাশ্রিত ঘটনা, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহ, পূর্বরাগ প্রভৃতিতে গায়নের মাঝে ব্যাখ্যা থাকে। অমন প্রেম-বিরহ তো আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। তা ছাড়া ভাবে আছে রূপক ও উপমা। কিন্তু, দুই বিঘা জমি-র কাহিনি তো আঞ্চলিক কৃষিজীবী শ্রোতাকে সর্বদাই ছুঁয়ে যাবে। কারণ, ঘটনাটি তো কৃষকের ডাঙা-কৃষি-বাস্তুর কাহিনি। ওতে ব্যাখ্যা লাগে না।” দীর্ঘ ব্যাখ্যা অনিলের।
আরও জানা গেল, দুই বিঘা জমি-তে মিশিয়েছেন ‘শিবরঞ্জনী’ রাগ। যা কীর্তন গায়কদের অতিপরিচিত, পুরাতন প্রিয় রাগ। কিন্তু এত সবের মধ্যেও অনিলবাবুর কীর্তনে, নিজের পছন্দের বিশেষ পালা, ‘বিরহ পর্ব’। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বিনত মানুষটির গুরুঘর অর্থাৎ কীর্তন শিক্ষা হাওড়া-শ্যামপুরের দয়ালচন্দ্র কয়ালের কাছে। সোদপুর টু শ্যামপুর যাওয়া-আসা দেড় দশক। এর পর গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে, হাওড়া-হুগলি-দুই মেদিনীপুর ও দুই ২৪ পরগনায় আসর।
বিদ্যালয়ের পাঠ সামান্যই, ক্লাস এইট। তবে, “বিষয়ের প্রতি প্রেম থাকলে, গাঢ় আগ্রহ থাকলে, অনেক দূর হাঁটা যায়। আমাকেও অনেক দূর যেতে হবে। একটা অনুপ্রাস শুনুন। ‘পালা পালা (পালা-গান) করিস না রে/পালা এত সহজ কি/ক’জনই বা পেলেছে (পালন) পালা/সবাই যে পালিয়ে মরে/যখন সকল ছোটা-ছুটির হবে ছুটি/পালাবে রে অমর আত্মা, ওরে....।” গেয়ে ওঠেন অনিল।
স্কুল জীবনের পরে, মার্কসীয় দীক্ষা। ঘরে বৈষ্ণব দর্শন, চৈতন্য জীবনী, বৈষ্ণব কোষগ্রন্থ সংগ্রহবিস্ময়ের। কিন্তু এই কীর্তনীয়ার সাংস্কৃতিক ধারা পরিবারের কেউ কি বয়ে নিয়ে যাবে? একটি শব্দে উত্তর এল, ‘না’। কারণ? একমাত্র পুত্র ম্যানেজমেন্ট পাশ দিয়ে মার্কেটিং-এ। বড় মেয়ে চাকরির চেষ্টায়, ইংরেজিতে এম এ। ছোট মেয়ে অর্থনীতির ছাত্রী। সে অর্থে এই কীর্তনীয়া সফল এবং ব্যর্থও। কারণ? এই গায়কী ঘরানা বহন করার মতো পরিবারের পরিবারের কেউ নেই। হয়তো আসবেও আসবেও না ভবিষ্যতে হয়তো।
|