মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারির পাড়ে গঙ্গার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িটা। হাজারদুয়ারি প্যালেস, জাদুঘর দেখা শেষ। এ বার ফিরতে হবে। ঝকঝকে গাড়ির মধ্যে শীতের ছুটিতে বেড়ানোর আনন্দে মশগুল মা-ছেলে। গাড়ির চালক পিছনের দিকের কাচ মুছছেন। পরিবারের কর্তা ছোট্ট মেয়েটির হাত ধরে গাড়িতে ওঠে পড়ার অপেক্ষায়।
আচমকাই গাড়িটা পিছনে গড়িয়ে যেতে থাকে ভরা নদীর দিকে। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে কাচ বন্ধ গাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া মা আর সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া ছেলেটি। সেকেন্ড কয়েকের ব্যাপার। শেষ বিকেলে ঝুপ করে গঙ্গায় পড়ে গেল গাড়িটি। গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে নদীতে পড়লেন চালকও। ঘাটের লোকজন, হাজারদুয়ারির মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পর্যটকেরা ছুটে এসেছিলেন। পড়িমরি করে ছুটে এসেছিলেন জয়দেব মজুমদারও (৪৮)। কিন্তু ঢালু পাড় বেয়ে নদীর দিকে গড়িয়ে যাওয়া গাড়ি ধাক্কা দিয়ে তাঁকেও ঠেলে দেয় নদীর দিকে। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে শনিবার তলিয়ে গেলেন তিনিও। |
মুর্শিদাবাদ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মৃণাল মজুমদার বলেন, “জয়দেববাবু ও চালক পিছন থেকে গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু গাড়ির ধাক্কায় তাঁরাও জলে তলিয়ে গিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্ত থেকে জানা গিয়েছে।” স্থানীয় বাসিন্দারা ঝাঁপিয়ে পরে ছোট্ট শ্রেয়াকে কোনওরকমে রক্ষা করলেও চোখের সামনেই সে দেখল মা-বাবা-দাদাকে নিয়ে গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে তাদের গাড়ি।
এ দিন রাত পর্যন্ত উত্তর কলকাতার উমেশচন্দ্র দত্ত লেনের বাসিন্দা জয়দেব মজুমদার (৪৮), তাঁর স্ত্রী রূপাদেবী (৪১) এবং তাঁদের বছর পনেরোর ছেলে দেবরাজের খোঁজ মেলেনি। খোঁজ নেই তলিয়ে যাওয়া গাড়ির চালকেরও। জয়দেববাবু কলকাতার মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের ম্যানেজার। কলকাতা ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি যথেষ্ট।
এ দিন দুপুরেই মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতার ওই পরিবারটির ফিরে যাওয়া কথা ছিল বর্ধমানে। সেখানে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল জয়দেববাবুর। শুক্রবার বিকেলে কলকাতা থেকে একটি ভাড়া গাড়িতে জয়দেববাবু সপিরবার রওনা দিয়েছিলেন বর্ধমানে। সেখানে তাঁর মা স্বর্ণলতাদেবীকে রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন তারাপীঠ হয়ে মুর্শিদাবাদে। কথা ছিল বর্ধমানে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার। সন্ধ্যায় ক্রেন দিয়ে গাড়িটি তোলা হয়। কিন্তু ওই ৪ জনের হদিস মেলেনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “বিভিন্ন এলাকা থেকে ডুবুরি নিয়ে আসা হয়েছে। তল্লাশি চলবে।” জয়দেববাবুর বছর ছয়েকের মেয়ে শ্রেয়া আপাতত মুর্শিদাবাদ থানায়। |
থানায় কেঁদে আকুল ছোট্ট শ্রেয়া। |
গাড়িটা গড়িয়ে গেল কী করে? হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়ার মাঝখানে ভাগীরথীর পাড়ে গাড়ি রাখার জায়গা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়ির সামনেই বসেছিলেন রূপাদেবী ও তাঁর ছেলে দেবরাজ। কলকাতা মেট্রোপলিটন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র দেবরাজ বসেছিল চালকের আসনে। মৃণালবাবু বলেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, গাড়িটি নিউট্রাল অবস্থায় ছিল। কোনও ভাবে গড়িয়ে গিয়েছে। নদীর পাড় ঢালু হওয়ায় তাকে আর থামানো যায়নি। জয়দেববাবু ও চালক দু’জনে মিলে পিছন থেকে ঠেলে গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু গাড়িটিকে আটকানো যায়নি।”
মুর্শিদাবাদ থানায় বসে শ্রেয়া বলে, “বাবার বাঁ হাত ভাঙা। তাই ওই হাতে বেশি জোর ছিল না। না হলে বাবা ঠিক গাড়িটা আটকে দিত, মা-দাদা জলে ডুবত না।” নদীতে এখন জলের গভীরতা ১৫-২০ ফুট। ফরাক্কা ফিডার ক্যানাল থেকে জল ছাড়ায় গঙ্গায় স্রোতও রয়েছে যথেষ্ট। ঘটনার সময় হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন স্থানীয় যুবক ইকবাল শেখ।
তিনি বলেন, “মোবাইলে কথা বলছি। হঠাৎ নজর পড়ে গাড়িটি পিছন দিকে গড়িয়ে নদীর দিকে চলে যাচ্ছে। গাড়ির ভিতরে রয়েছেন এক মহিলা ও একটি ছেলে। তিন বন্ধুতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মহিলাকে টেনে বার করার চেষ্টা করতেই গাড়িটি তলিয়ে যায়। ওই সময় মহিলা চিৎকার করে বলেন, ‘ছেলে আর মেয়েকে ওদের বাবার হাতে দিও!’ তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর স্বামীও যে তলিয়ে গিয়েছেন তা জানতেই পারিনি তখন।”
|
শনিবার গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
অতিরিক্ত প্রতিবেদন: কৌশিক ঘোষ |