ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের আগুনে দমবন্ধ হয়ে ৯১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিনই হাসপাতালের ছয় ডিরেক্টরকে দশ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আলিপুরের আদালত। শুক্রবার, অগ্নিকাণ্ডের দিনেই সংস্থার সাত কর্তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ছ’জনকে আজ আদালতে হাজির করা হয়। অন্য জন পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। আদালত চত্বরে ধৃতদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় আইনজীবী ও মুহুরিদের সংগঠন। তাদের আপত্তিতে অভিযুক্তদের হয়ে সওয়ালও করতে পারেননি তাঁদের আইনজীবীরা।
আমরি-কাণ্ড নিয়ে শুক্রবারই দমকল ও পুলিশের তরফে দু’টি তদন্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই কাজ শনিবার শুরুও হয়েছে। কিন্তু এ দিন রাতেই মুখ্যমন্ত্রী জানান, “আমরির ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হবে। এতগুলো লোকের মৃত্যু হল। এই ঘটনা কী করে ঘটল, তা তো জানা দরকার।” তবে কার নেতৃত্বে এই তদন্ত হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি দমকল ও পুলিশের তদন্তও চলবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আমরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেও এ দিন পাঁচ সদস্যের একটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ দিকে, শুক্রবারের ঘটনায় এ দিন আরও এক জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ইমরান খান নামে খিদিরপুরের ওই বাসিন্দা শনিবার সকালে এসএসকেএম হাসপাতালে মারা যান। উল্লেখ্য, শুক্রবার গভীর রাতে ঢাকুরিয়ার হাসপাতালে মৃত্যু হয় পূর্ব যাদবপুরের বাসিন্দা মৃদুলা গুহঠাকুরতার (৭৫)। ফলে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৯১। এ দিন আর একটি দেহ শনাক্তও করা গিয়েছে। তিনি কোলাঘাটের পঞ্চানন মাইতি (৪৫)।
আলিপুরের ভারপ্রাপ্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এস এম শাহনওয়াজ খান এ দিন আমরির ছয় ডিরেক্টরকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পরে যৌথ উদ্যোগে চলা এই হাসপাতালে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদেরও গ্রেফতার করা হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি সূত্রে খবর, আমরির পরিচালন পর্ষদে রয়েছেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দুই কর্তা। কিন্তু এ দিন রাত পর্যন্ত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি বলে পুলিশ জানায়। মুখ্যসচিব অবশ্য বলেছেন, “ওই হাসপাতালে সরকারের অংশীদারি ক্রমশ কমেছে। তা ছাড়া, সরকারি প্রতিনিধিরা শুধু পরিচালন পর্ষদের বৈঠকেই থাকেন। তাঁরা প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। তবু প্রয়োজন হলে তাঁদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে।”
আদালত চত্বরে এ দিন বড়সড় বিক্ষোভের মুখে পড়েন আমরির ছয় ডিরেক্টর এস কে তোদি, আর এস গোয়েন্কা, মণীশ গোয়েন্কা, প্রশান্ত গোয়েন্কা, রবি তোদি এবং ডি এন অগ্রবাল। (আর এক ধৃত রাধেশ্যাম অগ্রবাল সুস্থ হলে তাঁকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।) অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে মিছিল করে আলিপুর মুহুরি অ্যাসোসিয়েশন। তারা জানিয়ে দেয়, অভিযুক্তেরা জামিন পেলেও কেউ জামিনদার হবেন না। মিছিলের পরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসের সামনে ধর্নায় বসে পড়েন মুহুরিরা। এরই মধ্যে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে বড়বাজার কংগ্রেস কমিটি। মেন গেট থেকে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আসার রাস্তার মুখে অবস্থানে বসে পড়ে তারা। |
আদালতে অভিযুক্তরা |
|
|
|
(বাঁ দিক থেকে) শ্রবণ তোদি, রবি তোদি ও আর এস গোয়েন্কা। ছবি: সুমন বল্লভ। |
|
|
|
|
ডিএন অগ্রবাল |
প্রশান্ত গোয়েন্কা |
মণীশ গোয়েন্কা |
|
ধৃতদের আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকেই এ দিন এসেছিলেন আদালতে। বিক্ষোভের হাত থেকে রেহাই পাননি তাঁরাও। কখনও তাঁদের উদ্দেশে টিটকিরি উড়ে আসে। কখনও আইনজীবী বা মুহুরিরা চিৎকার করে বলেন, “অভিযুক্তদের আত্মীয়েরা যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও দয়া করে এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ করুন।” পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ডিসি সাউথ দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ। বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বিক্ষোভ এড়াতে শেষ পর্যন্ত সওয়া দু’টো নাগাদ কড়া নিরাপত্তার মধ্যে জেলা পরিষদের গেট দিয়ে ঢুকিয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে পুলিশ লক-আপে নিয়ে আসা হয় অভিযুক্তদের। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁদের এজলাসে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে আলিপুর ক্রিমিনাল বার অ্যাসোসিয়েশন জানিয়ে দেয়, তাদের কোনও আইনজীবী অভিযুক্তদের হয়ে দাঁড়াবেন না। অন্য কেউ লড়তে চাইলেও বাধা দেওয়া হবে। বস্তুত আদালত কক্ষে এসে অভিযুক্ত-পক্ষের আইনজীবী অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল মজুমদার, অতনু রায়চৌধুরীদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ‘অনুরোধ’ করা হয়, তাঁরা যেন জামিনের আবেদন না করেন। অমিতাভবাবু পরে বলেন, “আমাদের আবেদন জানাতে দেওয়া হয়নি। সে কথা বিচারকের নির্দেশে লেখাও হয়েছে।” অতনুবাবু বলেন, “বিবাদিপক্ষের আইনজীবীকে কিছু বলতেই দেওয়া হল না। এটা তো সাংবিধানিক অধিকার হনন।”
এ দিন সরকার-পক্ষের আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাইকোর্টের প্রধান সরকারি আইনজীবী দেবাশিস রায়। তাঁদের সাহায্য করার জন্য ছিলেন আলিপুর কোর্টের সরকারি আইনজীবী সত্যব্রত চৌধুরী, হাইকোর্টের আইনজীবী তমালকান্তি মুখোপাধ্যায় এবং রাজদীপ মজুমদার। কল্যাণবাবু বিচারককে বলেন, “গোটা দেশে আমরির দুর্ঘটনার মতো ঘটনা বিরল। ধৃতদের অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দমকলের পক্ষ থেকে বেসমেন্ট থেকে দাহ্যবস্তু সরানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “রাত আড়াইটেয় আগুন লাগলেও হাসপাতালের তরফে প্রশাসনকে খবর দেওয়া হয়নি। আগুন রোখার সরঞ্জাম কাজ করেনি। আপৎকালীন বেরনোর রাস্তা এবং সিঁড়ি জিনিসপত্র দিয়ে আটকানো ছিল।”
কল্যাণবাবু আদালতে দাবি করেন, জেরার মুখে ধৃতেরা যা বলেছেন, তাতে প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে। তাঁদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাই ধৃতদের ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার আবেদন জানান তিনি। এর পর সরকারি আইনজীবীরা বিবাদিপক্ষের আইনজীবীদের বলার অনুরোধ করলেও তাঁরা কিছু বলেননি। বিচাকর তখন ধৃতদের দশ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। |