সরঞ্জাম কই, ডিজি-র নির্দেশে সঙ্কটে পুলিশকর্তারা
ত্তেজিত জনতাকে সামাল দিতে পুলিশের আচরণবিধি কেমন (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর, সংক্ষেপে এসওপি) হওয়া উচিত, তা নিয়ে ডিজি’র নির্দেশ ইতিমধ্যে সব জেলায় পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। কারণ, নির্দেশটি অবিলম্বে কার্যকর করতে হলে থানাগুলোয় যে পরিকাঠামো থাকা দরকার, তা আদৌ নেই।
রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের জারি করা মূল নির্দেশটি ছিল পুলিশের গুলিচালনা সম্পর্কে। পুলিশ গুলি চালাবে, অথচ লোক মরবে না এই ধারণার ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র পুলিশকে বলা হয়েছে প্রতিটি অভিযানে রবার বুলেট, প্লাস্টিক বুলেট কিংবা প্লাস্টিক পেলেট নিয়ে যেতে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই হোক বা বিদ্যুতের হুকিং কাটার অভিযান সব ক্ষেত্রে নির্দেশটি প্রযোজ্য।
অথচ বাস্তব চিত্র বলছে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলার থানার পুলিশকর্মীদের অনেকে ওই সব বুলেটের নাম হয়তো শুনেছেন, তবে ব্যবহার জানেন না। কোন বন্দুক থেকে তা ছোড়া হবে, সে ধারণাও নেই। এমনকী, অনেক পুলিশকর্তাও এ সব বিষয়ে সম্যক ওয়াকিবহাল নন। এমতাবস্থায় ডিজি-র নির্দেশ ‘অবিলম্বে’ কী ভাবে পালিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন থানায় তো বটেই, এমনকী অনেক ক্ষেত্রে খোদ জেলা পুলিশ সদরেও পর্যাপ্ত রবার বুলেট বা প্লাস্টিক বুলেট নেই। রবার বুলেট ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের বন্দুক (গ্যাস গান) থেকে। প্লাস্টিক বুলেট ছুড়তে লাগে ৩০৩ রাইফেল। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের প্রশ্ন, বন্দুক মজুত থাকলেও বুলেট কোথায়? আর প্লাস্টিক পেলেট ছুড়তে যে ধরনের বন্দুক লাগে, অধিকাংশ থানার পুলিশকর্মীরা তা চোখেই দেখেননি। প্লাস্টিক পেলেট ব্যবহারের প্রশিক্ষণও পুলিশকর্মীদের সে ভাবে দেওয়া হয় না বলে কর্তাদেরই একাংশের অভিযোগ।
দেখা যাক, জেলায় জেলায় ‘বিকল্প’ বুলেটের মজুতভাণ্ডার কেমন।
মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, হরিহরপাড়া ও ভগবানগোলার মতো থানায় সাকুল্যে একটা করে ‘গ্যাস গান’ ও পাঁচটা করে রবার বুলেট আছে। জেলার অধিকাংশ থানায় তা-ও দেওয়া হয়নি। পুরনো অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ও খেজুরি থানায় যথেষ্ট সংখ্যক রবার বুলেট সরবরাহ করা হয়েছে বটে, কিন্তু জেলার অধিকাংশ থানায় দেওয়া হয়নি। বীরভূমে জেলা পুলিশের সদরে হাতে গোনা কয়েকটা বন্দুক ও বুলেট রাখা আছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন থানা সেগুলোই ভাগ করে নেয়। হাওড়া গ্রামীণ এলাকায় ১১টি থানার মধ্যে শুধু ডোমজুড়, বাগনান ও উলুবেড়িয়ায় একটা করে ‘গ্যাস-গান’ মজুত। বাকি থানাগুলোর জন্য সব মিলিয়ে দু’টো!
উত্তরবঙ্গেও একই ছবি। অর্ধেক থানায় রবার বুলেটের বালাই নেই। বাকিগুলোয় গড়ে ২৫-৫০টি থাকলেও তা ঠিকঠাক ছোড়ার মতো প্রশিক্ষিত অফিসার-কর্মীর যথেষ্ট অভাব। সব মিলিয়ে জেলায় মজুত রবার বুলেটের সংখ্যা একশোরও কম। তা ছোড়ার জন্য প্রয়োজনীয় বন্দুকও নগণ্য। উপরন্তু উত্তরবঙ্গের শতাধিক থানার জন্য একটামাত্র জলকামান। সেটা শিলিগুড়ির মাল্লাগুড়ি পুলিশলাইনে রাখা। ফলে একই দিনে উত্তরবঙ্গের একাধিক স্থানে বড় মাপের ‘আইন অমান্য’ হলে সামাল দিতে পুলিশকে নাকানিচোবানি খেতে হয়। এক পুলিশকর্তা জানাচ্ছেন, থানাগুলোয় কাঁদানে গ্যাসের শেলও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
এরই মধ্যে ডিজি-র নির্দেশমতো বিভিন্ন থানা থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসম্ভার পুলিশ কন্ট্রোলে জমা পড়তে শুরু করেছে। কনেস্টবলদের রাইফেলের বদলে লাঠি হাতে পাঠানো হচ্ছে ডিউটিতে। এই পরিস্থিতিতে কোথাও কোনও বড় ঘটনা ঘটে গেলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিভিন্ন জেলার পুলিশকর্তারা। এ ব্যাপারে মহাকরণ থেকে নির্দিষ্ট নির্দেশ এখনও না-পাওয়ায় নিচুতলার পুলিশকর্মীদের প্রশ্নেরও কোনও জবাব তাঁরা দিতে পারছেন না।
বস্তুত লিখিত নির্দেশ না-আসার কারণে ডিজি তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে জানানোর পরেও জেলায় জেলায় পুলিশমহলে বিভ্রান্তি ও সংশয়ের ছায়া। দক্ষিণবঙ্গের এক ডিএসপি স্তরের অফিসার জানাচ্ছেন, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনতে সরকারি দফতরগুলো সব সময়ে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা চায়। থানা থেকে দেওয়াও হয়। এ ছাড়া লকার কিংবা ভল্ট আছে যে সব ব্যাঙ্কে, সেখানেও দিনভর সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন থাকে। কিন্তু বুধবার থেকে নিয়মটা বদলে গিয়েছে বিভিন্ন জেলায়। কী রকম?
দক্ষিণবঙ্গের এক জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক অফিসার এ দিন বলেন, “ব্যাঙ্কের টাকা আনতে সশস্ত্র পুলিশ দেওয়া হবে কি না, এক ওসি আমার কাছে তা লিখিত ভাবে জানতে চেয়েছিলেন। অথচ আমি মহাকরণ থেকে কোনও লিখিত নির্দেশ পাইনি। কীসের ভিত্তিতে নির্দেশ দেব? পরে শুনেছি, ব্যাঙ্কের ডিউটিতে লাঠিধারী পুলিশ পাঠানো হয়েছে!” একটি জেলার এক পুলিশ-কর্তার মন্তব্য, “আগ্নেয়াস্ত্র যাতে কম ব্যবহার হয়, তা আমরা নিশ্চয়ই দেখব। কিন্তু সে জন্য পুলিশ এখন খালি হাতে ঘটনাস্থলে গেলে নির্ঘাত মার খেয়ে ফিরবে। পুলিশের হাতে বন্দুক থাকার মানে তো শুধু গুলি চালানো নয়! কিছুটা ভয় দেখানোও। যে ভীতিটা না-থাকলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন।”
এই বিভ্রান্তি নিরসনে সরকার কী করছে?
স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর: রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা এখন খোঁজ নিচ্ছেন, গুলিচালনার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর লক্ষ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে ডিজি-র ওই ‘মৌখিক’ নির্দেশ ঘিরে কোন কোন জেলায় বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যেমন, রাজ্য পুলিশের সদর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ বেশ ক’টি জেলার এসপি-দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এক পুলিশকর্তার কথায়, “ডিজি-র নির্দেশ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ-বিধিতে যে ভাবে ক্ষিপ্ত জনতাকে মোকাবিলার নির্দেশিকা রয়েছে, সব থানা যাতে তা মেনে চলে, এসপি-দের সেটাই নিশ্চিত করতে বলেছেন ডিজি।” কী সেই বিধি?
ডিজি এসপি-দের মনে করিয়ে দিয়েছেন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করা না-গেলে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে লাঠিচার্জ করতে হবে। তাতে ফল না-হলে ফাটাতে হবে কাঁদানে গ্যাসের শেল। অনেক সময়ে তাতেও কাজ হয় না। তখন দরকার জলকামান। তবু জনতা মারমুখী হয়ে থাকলে রবার বুলেট ছুড়তে হবে। তা-ও যদি নিষ্ফল হয়, তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে গুলি চালানো যাবে। কিন্তু সে ‘বিধি’ মানতে গেলে থানায় থানায় পর্যাপ্ত রবার বুলেট, কাঁদানে শেল, জলকামান ইত্যাদি তো রাখতে হবে! সেগুলোর অভাব কবে মিটবে, এটাই এখন প্রশ্ন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.