উল্টে গেল মতটা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বদলাতে যে-উদ্দেশ্যে অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে, কার্যত তার উল্টো পথে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করল উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কমিটিতে ছাত্র-প্রতিনিধি রাখার ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে এখনও।
উচ্চশিক্ষায় দলীয় রাজনীতির দাপট রুখতে বামফ্রন্টের আমলে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংশোধন এনে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে রাজ্যের নতুন সরকার। ওই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব বর্তেছে মূলত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরেই। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সর্বোচ্চ কমিটিগুলিতে আধিকারিক, শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্বের কোনও ব্যবস্থা নেই। অর্ডিন্যান্স এনেই শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের অবসান ঘটানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এই সব প্রতিনিধি নির্বাচন কার্যত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের লড়াইয়ে পরিণত হয়। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলে। বিগত তিন দশকে আলিমুদ্দিন নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটাই দস্তুর হয়ে উঠেছে।
ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এর বিপরীতে চলার চেষ্টা শুরু করে। উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই দিকটিও তাদের বিবেচনা করতে বলে সরকার। সেই কমিটির সদস্যেরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যথাসম্ভব রাজনীতিমুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটিতে ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিকদের প্রতিনিধি না-রাখার সুপারিশ করেছিলেন। সেই অনুসারে অর্ডিন্যান্সও জারি হয়।
কিন্তু এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করে এসএফআই। এমনকী তৃণমূল ছাত্র পরিষদও সর্বোচ্চ কমিটিগুলিতে ছাত্র-প্রতিনিধি রাখার পক্ষে সওয়াল করে। আধিকারিক এবং শিক্ষাকর্মীদের সংগঠনগুলিও প্রতিনিধিত্বের দাবি জানায়। সরব হয় শিক্ষক সংগঠনগুলিও। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই অর্ডিন্যান্সের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মাধ্যমে শিক্ষক, ছাত্র, আধিকারিক, শিক্ষাকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়, ব্যক্তিগত ভাবে অথবা সংগঠনের তরফে তাঁরা এই ব্যাপারে রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদে মতামত জানাতে পারেন। মতামতের প্রতিলিপি পাঠাতে বলা হয় উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে।
দ্বিতীয় দফায় আলাপ-আলোচনার পরে উচ্চশিক্ষা কমিটি সেনেট-সিন্ডিকেট, কোর্ট-কাউন্সিলে আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব রাখার সুপারিশ করেছে। উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদও এই ব্যাপারে সহমত হয়েছে। তবে ওই সব কমিটিতে ছাত্র-প্রতিনিধি না-রাখার ব্যাপারে এখনও তারা একমত।
এতে কি সেই রাজনীতির অনুপ্রবেশের বন্দোবস্তই করা হল না?
সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই যে প্রথমে এঁদের প্রতিনিধিত্বের কথা অর্ডিন্যান্সে রাখা হয়নি, উচ্চশিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির এক সদস্য তা স্বীকার করেন। তবে সেই সঙ্গেই তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনায় মনে হয়েছে, কোর্ট-কাউন্সিল বা সেনেট-সিন্ডিকেটে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। কারণ, আধিকারিক এবং শিক্ষাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেরই অংশ। আর পঠনপাঠন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়সড় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলে। সেই কারণেই এখন বিশ্ববিদ্যালয় আইনে আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটির ওই সদস্য অবশ্য জানিয়ে দেন, আধিকারিক-শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধির সংখ্যা মোটেই এমন হবে না যে, তাঁরা সংখ্যার জোরে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারেন। তাই তাঁদের নির্বাচন ঘিরেও বড় ধরনের রাজনৈতিক লড়াই হবে না বলেই মনে হয়।
তবে এই সব কমিটিতে নির্বাচিত ছাত্র-প্রতিনিধি রাখা হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞ কমিটির ওই সদস্য জানিয়ে দিয়েছেন। কমিটির বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্রদের কী ভূমিকা থাকতে পারে! মূলত শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের মতামত বা চাহিদার কথা জানানো প্রয়োজন। তাই অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে তাঁদের প্রতিনিধি থাকবে, যেমন এত দিন থেকেছে। বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞদের পরামর্শ যাতে বেশি করে পাওয়া যায়, সেই জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আগের চেয়ে অনেক বেশি অধ্যাপক-প্রতিনিধিত্বের বন্দোবস্ত রাখা হচ্ছে বলেও উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর।
রাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও মনে করেন, প্রশাসনের অংশ বলে আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধি থাকতেই পারে। কিন্তু কোনও ছাত্র-প্রতিনিধির সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আধিকারিক, শিক্ষাকর্মীদের ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা না-হওয়াই ভাল। তবে সর্বোচ্চ কমিটির সামনে ছাত্র সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানানোর সুযোগ থাকা উচিত। তাঁরা নিজেদের বক্তব্য জানানোর পরে আর বৈঠকে থাকবেন না। তাই তাঁদের স্থায়ী প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি নয়।
কিন্তু ছাত্র-প্রতিনিধি না-রাখার সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকায় ফের আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে এসএফআই। ওই সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নির্বাচিত ছাত্র-প্রতিনিধি নিলে দলতন্ত্র, আর নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী তাঁদের বাদ দিয়ে দেওয়াটা রাজনীতি হল না? ছাত্রেরা দেশের সরকার পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁদের সামিল করলেই সমস্যা?”
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এসএফআই জোরদার আন্দোলন শুরু করবে বলে জানান ঋ তব্রত। সেনেট-সিন্ডিকেটে ছাত্র-প্রতিনিধি রাখার দাবি জানিয়েছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদও। ওই সংগঠনের উপদেষ্টা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “এই ব্যাপারে আমরা দলে আলোচনা করব।” |