আনারকলি না? চোখের চারপাশে ঘন কালো ছোপ, কানের লতিতে ছড়ানো ছিটানো সাদা ছিট, শুঁড়ে লেপ্টে রয়েছে কবেকার সিঁদুর। অবিকল আনারকলির মতো।
বহরমপুরে পা দিয়েই মাঝ-বয়সি আনারকলি অবশ্য হয়ে গিয়েছে ‘কুসুমকলি’। লালবাগে পৌঁছে তার নাম হল ‘জয়মালা’, আর মুর্শিদাবাদের সেই প্রাচীন জনপদ ছেড়ে হেলেদুলে আমবাগানের দিকে রওয়ানা দিতেই প্রশ্ন করি, ‘হাতির নাম কী গো?’ এ বার ভ্রূ কুঁচকে যায় মাহুতের, “ইতনা পুছ তাজ-কা কেয়া হ্যায়, ইসকা নাম চুনচুনমালা!”
বাস্তবিকই নাম বদলে যায়, আনারকলি বদলায় না! |
নভেম্বরের গোড়ায় (৮ নভেম্বর) বর্ধমান শহরের অলি গলি ঘুরে শিশু-বুড়ো নির্বিচারে পিঠে চাপিয়ে পাঁচ-দশ টাকা আয়ের এক দুপুরে আচমকাই ক্ষেপে গিয়েছিল আনারকলি। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়, অতি উৎসাহীর লেজ ধরে হ্যাঁচকা টান, চ্যাংড়া যুবকের সিগারেটের ছ্যাঁকা, কানের পাশে নাগাড়ে গাড়ির হর্ণসব মিলিয়ে তিতিবিরক্ত হস্তিনী আনজা গলির মুখে হঠাৎই টেনে নিয়েছিল বছর আটেকের বিবেককে।
বিবেক সাহনি। ছেলেটি খানিক আগেই বাবার কাছে বায়না করে দশ টাকা দিয়ে হাতির পিঠে চড়েছে। পিঠ থেকে নেমে এক বার শুঁড় ছুঁতে হাত বাড়িয়েছিল। আর তখনই ঘটে গিয়েছিল সেই অভাবনীয় ঘটনাটি। মিনিট কয়েকের জন্য একেবারেই ‘অচেনা’ হয়ে গিয়েছিল আনারকলি। বিবেকের শীর্ণ হাত শুঁড়ে জড়িয়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়েছিল সে। তারপর ছেলেটিকে সামনে ফেলে নিজের ভারি পা-টা তুলে দিয়েছিল বিবেকের মাথায়। নিমেষে হাতি-ঘিরে থিকথিকে ভিড়টা থমথমে হয়ে গিয়েছিল।
বিস্তর আইন খুঁজেও পুলিশ অবশ্য আনারকলিকে সে যাত্রা গ্রেফতার করেনি। বর্ধমান থানার বড়বাবু মাথা চুলকে বলেছিলেন “ওকে কাস্টডিতে রাখব কী করে?” আর বন দফতর গম্ভীর গলায় রায় দিয়েছিল, হাতির মালিকানার বৈধ কাগজপত্র থাকলে তাকে গ্রেফতার করার প্রশ্ন নেই। অতএব হাতকড়া পড়েছিল হাতির মালিক অনিল দুবের। পাক্কা ২১ দিন জেল হাজতের পরে সদ্য মুক্তি পেয়েছেন অনিল।
|
মাহুত। |
বেনারসের আদি ঠিকানা থেকে ‘ভিক্ষা’ করতে বেরনো আনারকলি অবশ্য তত দিনে দুই জেলা ডিঙিয়ে তার অন্য দুই মাহুতের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে। অনিল পাড়ি দিলেন সেখানেই। তবে অনিল নয়, জিজ্ঞাসা করলে অনিল বলছেন, তিনি আশিস দুবে। কখনও সুনীল। বিরক্ত হয়ে শেষতক বললেন, “আরে ভাই ম্যায় তো রাজেন দুবে...।”
কিন্তু নিজের পোষ্য নিয়ে এ ভাবে পথে প্রান্তে ভিক্ষা করা যায়? দেশের বন্যপ্রাণ আইন তো সে কথা বলে না। সেই অভিযোগেই তো অনিল ওরফে সুনীল ওরফে রাজেনবাবুদের হাতে উঠতে পারে ফের হাতকড়া। জেলা পুলিশ কর্তারা কি শুনতে পাচ্ছেন?
মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের অবশ্য ঘুম ভাঙেনি। মুর্শিদাবাদ থানার আইসি ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু বলছেন, “না ভাই, আমি কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নই। তাই হাতিটিকে লালবাগ এলাকা পার করে দিয়েছি।” কিন্তু এ ভাবে ভিক্ষা করছে গ্রেফতার করছেন না যে? ইন্দ্রজিৎবাবু ঘন ঘন মাথা নাড়েন, “অত আইন জানা নেই!” তা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আন্নাপ্পা ই বা কী বলেন--“ওই হাতি বন্যপ্রাণ আইন ভেঙেছে কিনা তা তো খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।” আর প্রশাসন? অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অজয় ঘোষ বলেন, “দেখি, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশকে বলব।” বহরমপুর পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্যের আইন না জানায় ‘হাত-পা বাঁধা’ অবস্থা। আর স্থানীয় বনকর্তারা বলছেন, “হাতি পোষা তো বেআইনি নয়। তবে তাকে নিয়ে পথে ঘাটে হেঁটে ক্ষিক্ষা আইনি নয়। এমনকী আইন-শৃঙ্খলা ক্ষুন্ন হচ্ছে দেখলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতেই পারে। তেমন হলে আমাদের বললে আমরা হাতিটিকে ‘সেফ কাস্টডি’ হিসেবে চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিতে পারি।”
আইনের ঘোর-প্যাঁচে আর কে পড়তে চায়? পুলিশ-প্রশাসন-পুরসভা মায় বন দফতরও তাই দায় এড়াতে ব্যস্ত। বর্ধমান ছেড়ে, মুর্শিদাবাদের পথে তাই দুলকি চালে ঘুরছে আনারকলি, ওরফে কুসুমকলি ওরফে চুনচুনমালা।
|