প্রবন্ধ ১...
অযত্নের পরম্পরা নির্মাণ করে হিংসা
৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ভোররাত্রিটা ভোপালের মানুষজন ভুলতে চায়, পারে না। আমরা জানি সেই রাত্রে ইউনিয়ন কার্বাইড-এর কারখানা থেকে ‘ভুলবশত’ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস লিক করে লক্ষাধিক মানুষের ভবিষ্যৎ পঙ্গু করে দিয়েছিল। তিন থেকে সাত হাজার ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা মরে গিয়ে ল্যাটা চুকিয়ে দিয়েছে। বাকিরা এখনও জীবনযুদ্ধে শামিল। ১৯৮৯ সালে ডাও কেমিক্যালস ৪৭ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। ভারত সরকার প্রথমে চেয়েছিল এর প্রায় দশ গুণ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের ওই অঙ্কটাই মেনে নেয়।
১৯৮৪’র ১ থেকে ৩ নভেম্বর ধ্বংসলীলা চলেছিল দিল্লির আনাচেকানাচে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী নিহত হওয়ার পর ভোটার লিস্ট মিলিয়ে নাম-ঠিকানা খুঁজে মেরে ফেলা হয় শিখ-সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষকে। অপরাধীর শাস্তি? বিচার ‘চলছে’।
বর্ষপূর্তি। ভোপাল, ২ ডিসেম্বর ২০১১। ছবি:পি টি আই
দু’টো ঘটনাই হিংসার। দু’ধরনের হিংসা। একটি সরাসরি আক্রমণ, অন্যটি ‘দুর্ঘটনা’। দুটিরই ফল: বহুজনের সর্বনাশ। দিনগুলো ফিরে এলে আমরা উথলে উঠি। স্মরণ করি মৃতদের। জবাব চাই অন্যায়ের।
কিন্তু এই ঘটনাগুলো, এই ধরনের আরও অনেক ঘটনা, একটা বড় প্রশ্ন তোলে। হিংসা কি এক রাতের, কিংবা তিন দিনের, ঘটনায় শুরু আর শেষ? ভোপালের কথাই ধরা যাক। দগদগে একটা রাত্রি পাল্টে দিল বহু মানুষের বাকি জীবন। দুয়োরানির গল্পের মতো কাটতে থাকল গ্যাস-আক্রান্ত মানুষদের এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের দিনগুলো। তাঁদের জন্য যেটুকু করা হল, তা নামমাত্র বড়জোর বিপন্ন পরিবারের মুখে খাবার জোগানো, প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা, অল্প কিছু অর্থসাহায্য, একটা সেলাই কল। যে সব পরিবারের মাসিক আয় ছিল ৫০০ টাকা, তাদের এককালীন ১৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। বিধবা ভাতা স্থির হয় মাসে ২০০ টাকা, পরে তা বাড়িয়ে করা হয় ৭৫০ টাকা। পড়াশোনা-চাকরি-ভবিষ্যৎ? দূর কী বাত। হাসপাতালও হল অনেক পরে। সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল, যা কিনা কেবল গ্যাসে আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা করবে। কিন্তু যে সব রোগ হল, তা যে গ্যাস থেকেই হয়েছে, অন্য কিছু থেকে নয়, তার প্রমাণ চাইল হাসপাতাল। যারা প্রমাণ করতে পারল, তারা একটা-দুটো আলোর কণার পেছনে ভাগল। বাকিরা ওইখানেই টপাটপ শুরু করল আর এক প্রস্ত শ্মশান-যাত্রা। কিংবা জীবন্ত নরক-বাস। আর যারা তখনও জন্মায়নি? তারা যে পঙ্গু হয়ে জন্মেছে, তাদের যে শৈশব হল না, যৌবন হল না, ফিউচার হল না, বিয়ে হল না, সন্তানও হল না, কেউ কেউ তো কেবল বাটি-ভর্তি জলে আকাশ দেখল এ সব কি গ্যাসের কারণে? প্রমাণ কই, প্রমাণ? ইতিমধ্যে দুর্ঘটনার পঁচিশ বছর ধুমধাম করে পালিত হল, কিন্তু সেই ধুম পঁচিশ বছরের ঔদাসীন্যের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারল না। এ দায় কার? যদি সেই রাতের আক্রান্ত কোনও মানুষ বলে অন্যের ভুলের মাসুল আমি কেন সারা জীবন দিয়ে যাব? আমার সন্তান কেন পঙ্গু হয়ে জন্মাবে? আর যদি এটা দুর্ঘটনাই হয়, তবে তার প্রতিকারে সরকার কী করল? আমার সামর্থ্য থাকলে আমি তো অনেক টাকা রোজগার করতে পারতাম, কিন্তু আমার সামর্থ্য কেড়ে নেওয়া হল, তার বদলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল না। আর হল না তো হলই না।
একই কথা মনে হয়েছিল দু’বছর আগে, দিল্লির তিলক বিহার-এ উইডো কলোনিতে গিয়ে। ১৯৮৪’র ডিসেম্বরে এত শিখ পুরুষ মারা গিয়েছিলেন যে তাঁদের বিধবাদের জন্য একটা আলাদা কলোনি করতে হয়। সে সব গিয়েছে চলে সাতাশ সাতাশ বছরের পার। কিন্তু পলে পলে মাসুল দিয়ে চলেছে এই প্রজন্ম। মধ্যবিত্ত শিখ পরিবারের ছেলেমেয়েদের একটা অংশ তিন দিনের আগুন-উৎসবে পরিণত হল এক নষ্ট জেনারেশনে। না হল পুনর্বাসন, না পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ, না চাকরি, না একটা সুস্থ ভবিষ্যৎ। যে মা রোটি-সবজি বানিয়ে খাইয়ে পরিয়ে পরিবার নিয়ে ডগমগ ছিল, সে হয়ে গেল কাজের লোক, কিংবা পেটিকোট সেলাইয়ের কারখানায় মজুর। তার ছোট্ট ছেলেটা যখন বড় হতে থাকল, তখন মা-বাবা-পরিজন কাউকে পেল না। সঙ্গী হল দারিদ্র আর ড্রাগ। দেখার কেউ নেই, তাই বকারও কেউ নেই। যে মেয়েটার বয়স ছিল চোদ্দো, স্কুলে পড়ত, চাকরি আর বিয়ে দুটোই ভাল হতে পারত, সে হয়ে গেল বেশ্যা। অন্য বাড়ির ছেলেটা হল ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ধর্ষিতা বউদি হল মানসিক রোগী। তিন দিনের দাপটে একটা প্রজন্ম স্রেফ বেখেয়ালে নষ্ট হয়ে গেল। এটা তো দুর্ঘটনা ছিল না!
দু’টো ঘটনায় কী আশ্চর্য মিল না? একই হাড় হিম করা ঔদাসীন্য আর উপেক্ষা, যা গিলে নিল দু-তিনটে প্রজন্মের নিস্তরঙ্গ মধ্যবিত্ত জীবন, সুখ-শান্তি, তাদের বকাঝকা করা অভিভাবক। পরিবর্তে দিল কী? বেঁকে যাওয়া শিরদাঁড়া, বিষ-সমৃদ্ধ বুকের দুধ, অন্ধ-ল্যাংড়া-নুলো জীবন আর ক্ষোভ আর দারিদ্র আর অন্ধকার। অন্ধকার জীবন, অন্ধকার যৌবন, অন্ধকার পৌরুষ, অন্ধকার কাম, অন্ধকার চিন্তা, অন্ধকার অন্ধকার। তিলে তিলে, পলে পলে ফল্গু নদীর মতো চারিয়ে গেল এই ইনডিফারেন্স। নিতান্ত বেখেয়ালে, অগোচরে। কিন্তু আকার নিল ভয়ঙ্কর। ঝুপ ঝুপ করে যেমন অল্প অল্প পাড় ভেঙে নদী একটা সময় পুরো গ্রামটাকেই গিলে নেয়, ঠিক তেমনই।
সেই রাতগুলোয় যা যা ঘটেছিল, তার পর প্রয়োজন ছিল একটা দীর্ঘ সময়ের যত্নের। কিন্তু পরিবর্তে চিন্তায়, মননে, কার্য সম্পাদনে পাকাপাকি বাসা বাঁধল ‘অযত্ন’। যত্ন না নিতে নিতে এক সময় ক্ষতের তীব্রতা অন্যের মনকে আর ক্ষতবিক্ষত করল না।
ক্ষত দূর করার, যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। রাজধর্মের প্রধান এক অঙ্গ প্রজাদের যত্ন করা। শুনেছি আগেকার কালে মন্বন্তর হলে রাজভাণ্ডার খুলে দেওয়া হত প্রজাদের জন্য। কারণ প্রজাদের প্রতি পিতার ন্যায় ব্যবহারই রাজার ব্যবহার, তাঁর কর্তব্য। এ কালেও তেমনটা একেবারে দেখা যায় না তা নয়। গত মার্চ মাসে জাপানে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুকুশিমার নিউক্লিয়ার প্লান্ট। সারা পৃথিবী দেখেছে, কী ভাবে একটা একটা জীবনকে রক্ষা করেছে, শুশ্রূষা করেছে, বাঁচিয়ে তুলেছে জাপান সরকার। বিপর্যয়ের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সরকারি কর্তা নিজে বিপন্ন এলাকার পরিস্রুত জল খেয়ে ভরসা দিয়েছেন মানুষকে। আর ১৯৮৪ সাল থেকে ইউনিয়ন কার্বাইড সংলগ্ন এলাকার মানুষজন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম, বিষাক্ত জল খেয়ে তাঁদের পৌষ্টিকতন্ত্র, তাঁদের পাকস্থলীর জ্বালা দিয়ে মূল্য চুকিয়েছেন। এখনও সে জলে বিষ বর্তমান।
আমাদের রাজারা অযত্নের অভ্যেস থেকে নির্মাণ করেছেন ঔদাসীন্যের পরম্পরা। বহু পরিশ্রমে আর বহু লালনে বহু বছর ধরে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে রাষ্ট্র। সাতাশ বছর পরে এখন তো সে সব সুদূর অতীত, বিস্মরণযোগ্য। বিস্মরণযোগ্য? পঁচিশ কিংবা সাতাশ বছর পর ক্ষত আপনাআপনি শুকিয়ে যায় বুঝি? পঁচিশ বছর পর মৃত-পিতা নতুন পাগড়ি পরে ফিরে আসেন পরিবারের দায়িত্ব নিতে? ব্যাঁকা মেরুদাঁড়া সিধে হয়ে যায়?
এই ‘অযত্ন’ উৎসারিত হয়েছে একটা চরম ঔদাসীন্য থেকে। সেটা এক দিনে আসেনি। তার পিছনে আছে নিরলস অনুশীলন। আমাদের সকলের। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট, গণধোলাই, নেড়ি কুকুর পেটানো, মায়ের বাতের ব্যথা সব কিছুতেই আমরা উদাস হওয়া শিখি। ইগনোর করতে শিখি অপমান, ছোট্ট ঘা, ফুটপাতের শিশু, লোফার ছেলের দল। এই উদাসীনতাই ইন্ধন জোগায় মনে মনে অলস হওয়ার, আর এই বিরাট আলস্যের সুঅভ্যেসই করে তোলে অ-যত্নবান। নিজের প্রতি। অন্যের প্রতি। এই অযত্ন, আলস্য, উদাসীনতা আমাদের মধ্যে এমন ভাবে শিকড় ছড়ায় যে, যা আমার প্রাপ্য নয়, তাকেও গ্রহণ করি হেলায়। অন্যায়ের সঙ্গে সহবাস করি অবলীলায়।
এই যত্ন না নেওয়ার ট্রেনিং একে সহজে হিংসা বলে বোঝা যায় না। কিন্তু এটা হিংসা-ই। কঠোর ভাবে অনুশীলন করা এক গভীর অযত্ন নির্মাণ করে এই হিংসাকে। ঔদাসীন্য, অযত্ন আর বঞ্চনা যখন একটা মানুষকে তার স্বাভাবিক জীবন বাঁচতে বাধা দেয়, তখন সেটা হিংসায় রূপান্তরিত হয়। ধরুন একটা ছেলে একশো মিটার দৌড়ে প্রথম হচ্ছে। এমন সময় কেউ তাকে ধাক্কা দিল। এই হিংসা আমরা দেখতে পেলাম। নিজের চোখে। কিন্তু ধরুন, সেই ছেলেটাকেই দিনের পর দিন ভাল করে খেতে না দিয়ে, কোনও ট্রেনিং না দিয়ে মাঠে নামিয়ে বলা হল, ‘ফার্স্ট হয়ে দেখাও তো বাছা।’ সে পারবে না। কারণ সে প্রস্তুত নয় লড়ার জন্য, তাই না? মাঠে কিন্তু তার প্রতি বঞ্চনাটা আমরা দেখতে পেলাম না। সে যে খেতে পায়নি, ট্রেনিং পায়নি, সেটা দেখতে পেলাম না। তার প্রতি অযত্নটা, বঞ্চনাটা দেখতে পেলাম না।
আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পাই না, আমাদের সম্মিলিত ধারাবাহিক অযত্ন বহু মানুষের জীবন বাঁচার সামনে একটা কঠিন দেওয়াল তুলে দিচ্ছে, প্রতিহত করছে তাদের সুস্থ স্বাভাবিক অস্তিত্বকে। এমন একটা জীবন সে পেতে বাধ্য হচ্ছে, যা আসলে জীবনের নীচে। বিলো লাইফ লাইন। বি এল এল। আর ঠিক এই কারণেই এটা হিংসা। আমাদের সম্মিলিত অযত্ন আর ঔদাসীন্য রাজার বিস্মৃতির অনুশীলনকেও ধারণ করে রাখে। রাজা শরণাগতকে আশ্রয় দেয় না, যথাসম্ভব উপেক্ষা করে তাকে এমন একটা জীবনে ঠেলে দেয়, যে জীবনটায় দাঁড়িয়ে সে প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যু কামনা করে।
এই যে নিশ্চুপ, দীর্ঘায়িত হিংসা, সে জিতে যায়। বেদনায় আলস্য এসে যায়। আর তেমন করে ব্যথা পেতেও ক্লান্ত হয় মন, গোড়ালি, ফুসফুস কিংবা গলার নলি। ক্লান্তি আসে ক্রোধে, বিস্বাদ হয় কান্না, ক্ষতে এসে ঘর বাঁধে গন্ধ-মাছি। এত দিন ধরে নির্মিত এই হিংসার কাছে দেড়েমুশে পরাজিত হয় যন্ত্রণা, প্রতিবাদ, একটা আর-একটু-ভাল জীবনের আশা। আর নটেগাছ ঠিক একই ভাবে মুড়িয়ে যায়, যেমন গিয়েছিল সাতাশ বছর আগের দু’টো ঘটনায়।
তবে আমাদের মস্ত এক সুবিধে আমরা নিয়তিবাদে বিশ্বাসী। আত্মবিস্মরণ এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যে কোনও অন্যায় মেনে নিই বা মনে নিই এই বলে সবই কপাল!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.