ভারতে দুইটি রাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে প্রার্থীরা কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া থাকে: পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল। বামপন্থী মতাদর্শের কারণেই এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে। সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে পঞ্চায়েত আইন বদলাইয়া, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের নির্বাচনকে অ-রাজনৈতিক করিবার পরিকল্পনা জানাইয়াছে। প্রার্থীরা কোনও দলের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়াইবেন না, দাঁড়াইবেন ব্যক্তি হিসাবে। আশা করা হইতেছে, তাহার ফলে নির্বাচনে রাজনৈতিক হিংসা কমিবে, দলীয় সংঘাতের ফলে উন্নয়নমূলক কাজ থমকাইবে না, প্রকৃত গরিবকে প্রাপ্য হইতে বঞ্চনার ঘটনাও কমিবে। তবে আশঙ্কাও কম নহে। অন্যান্য রাজ্যের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট হইয়াছে যে, রাজনৈতিক দলগুলি খাতায়-কলমে প্রার্থী না দিলেও, প্রার্থীরা কার্যক্ষেত্রে কোনও না কোনও দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন পাইয়া থাকেন। ফলে কার্যত নির্বাচন ‘অরাজনৈতিক’ থাকে না। বরং পঞ্চায়েত স্তরে উন্নয়নের কাজ না হইবার দায় রাজনৈতিক দলগুলির থাকে না, একা প্রধান নানা প্রকল্পের প্রস্তাব লইয়া কখনও ব্লকে, কখনও জেলায় তদ্বির করিয়া বেড়ান। ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত হইতে রাজনৈতিক দলের প্রতীক অপসারণ করিলেই উন্নয়নের কাজে গতি আসিবে, এমন নহে।
বস্তুত নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রকৃতিই এমন যে তাহা ক্ষমতার প্রতি মানুষকে অধিক আগ্রহী করিয়া তোলে, জনকল্যাণ উপলক্ষ মাত্র বলিয়া মনে হয়। উদ্দেশ্য অপেক্ষা আয়োজন অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিবার কারণে বছর বছর নানা নির্বাচন হইতেছে অথচ কাজের কাজ হইতেছে অতি সামান্য। নির্বাচনের বাহিরে গণতন্ত্রের একটি বড় পরিসর রহিয়াছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে গণতন্ত্র কী রূপ লইবে, কী শর্তে এবং কোন উপায়ে গ্রামের মানুষ উন্নয়নে শামিল হইলে তাঁহাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হইবে, তাহা পুনরায় চিন্তা করিবার প্রয়োজন। ভারতে গণতন্ত্রের রীতিনীতি বারবার বদলাইয়াছে। উন্নয়নমুখী গণতন্ত্রে অধিক প্রয়োজন দক্ষতা এবং দায়বদ্ধতা। প্রতিনিধিত্বই শেষ কথা নহে।
গণতন্ত্র, রাজনীতি এবং নির্বাচন, এই তিনটির সম্পর্ক লইয়া যে চিন্তার সূচনা হইয়াছে, তাহাকে আরও বিস্তৃত করিবার প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। উন্নয়নের জন্য পঞ্চায়েত স্তরে যে প্রশ্নগুলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, রাজ্য স্তরে সেগুলি তোলা অনেকটাই নিরর্থক। আবার রাজ্য স্তরে যে বিষয়গুলি লইয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন, সেগুলি কেন্দ্রীয় স্তরের বিচার্য নহে। ভারতের সংবিধান অনুসারে প্রতিটি স্তরের সরকারের বিচার্য বিষয় আলাদা। উন্নয়নে তাহাদের ভূমিকাও এক নহে। অথচ একই রাজনৈতিক দলের প্রতীকে সকল স্তরে প্রার্থীরা দাঁড়ান বলিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে সমর্থন করিতে বিধানসভা ভোটেও ক্ষমতাসীন দল বা শরিক দলকে সমর্থন করিতে হয়। ফলে নাগরিকরা নীতি, প্রকল্প কিংবা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ বা সমর্থন করিবার সুযোগ পান না, কেবল কোনও দলের প্রতি প্রায় নির্বিচারে সমর্থন বা অনাস্থার সুযোগ পাইয়া থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকরা ভোট দিয়া নির্ধারণ করেন, তাঁহার এলাকায় ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান প্রার্থী কে হইবে। তখনই প্রার্থীকে জানাইতে হয়, কোন নীতিতে তাঁহার অবস্থান কী। কিন্তু ভারতে প্রার্থী স্থির করে রাজনৈতিক দল, নাগরিক নহে। সুতরাং গ্রামে, জেলায় কিংবা রাজ্যের উন্নয়নে কে কী অবস্থান লইবে, তাহা না জানিয়াই প্রার্থীকে সমর্থন করিতে হয়। রাজ্যের সিদ্ধান্ত রাজ্যেই লইতে হইবে, দিল্লিতে নহে। সুতরাং প্রার্থীও হওয়া প্রয়োজন রাজ্যের দলের। একই দলের প্রতীকে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে নির্বাচন হওয়া তাই অযৌক্তিক। নির্বাচনকে উন্নয়নের উপায় করিয়া তোলার ইহাই পথ। |