হাত ধরে হিড়হিড় করে টান মারার সেই স্মৃতি এত দিন ঘুরেফিরে আসত বছর পনেরোর মুক্তি মাঝির মনে। আজ রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের কাছ থেকে সংবর্ধনা নেওয়ার সময় বোধহয় সেই দুঃস্বপ্ন থেকে ‘মুক্তি’ ঘটল।
আর পাঁচ জন কিশোরীর মতোই চড়ক সংক্রান্তির রাতে গ্রামের মাঠে নাচতে গিয়েছিল মুক্তি। কখন পাশের গ্রামের ছেলের নজর পড়েছে বুঝতে পারেনি। ফিরতি পথে অন্ধকারে মুক্তিকে টানতে টানতে নিজের বাড়ি নিয়ে যায় ছেলেটি। বাধ্য করা হয় এক রাত থাকতে। বলা হয় ‘‘তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তুমি আজ থেকে বিবাহিত।’’
প্রথার আগল মানতে চায়নি মুক্তি। ভোরের আলোয় নিজের বাড়িতে ফিরে আসে সে। গাঁও-বুড়োরা বলেছিল, ফিরে যাও। শুরু হয় মুক্তির প্রতিবাদ। সমাজের মাথাদের জানিয়ে দেয়, ওই বিয়ে মানে না সে। সে পড়তে চায়। শ্যামলা মেয়ের জেদের কাছে প্রথমে হার মানে পরিবার। তার পর সমাজ। আজ সংবর্ধনা নিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের সঙ্গে যখন হাত মেলাচ্ছে মুক্তি, তখন তার চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। লাজুক হেসে সে বলে, “সে দিনের অভিশাপ থেকে বোধহয় আজ মুক্তি পেলাম।” |
সপ্তম শ্রেণির মুক্তি আজ একা নয়। মুক্তির লড়াই অজান্তেই কখন মিশে গিয়েছে পুরুলিয়ারই সঙ্গীতা বাউরি, বীণা কালিন্দী আর আফসানা খাতুনদের সঙ্গে। এরা প্রত্যেকেই আলাদা। আবার একও। সকলেরই অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই রুখে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে না করে পড়তে চেয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছে নিজের পায়ে।
অজ পাড়া-গাঁয়ের কিশোরীদের অদম্য লড়াইকেই আজ সম্মান জানালেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর কথায়, “তোমরা সমাজের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমার মিডিয়া উপদেষ্টা অর্চনা দত্তের কাছে তোমাদের লড়াইয়ের কাহিনি শুনেছি। আমি চাই, শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন গোটা দেশের কাছে তোমাদের কাহিনি পৌঁছে যাক।”
বাঘমুন্ডি জেলার ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়ে বীণা কালিন্দী। দু’বছর আগে পড়া ছেড়ে বিয়ে করতে হবে ফরমান জারি করেছিলেন বীণার বাবা। খর্বকায় মেয়েটি শুধু মৌখিক প্রতিবাদ করে ক্ষান্ত থাকেনি। চার-চারটি পাত্রপক্ষকে পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ভুরশু গ্রামের বীণা আজ তাই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ইউনিসেফ-এর প্রচারে ভারতের মুখ। তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “শুধু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। তুমি তো বাবার মদ্যপানের অভ্যাসও ছাড়িয়ে দিয়েছ বলে শুনেছি।”
অগুনতি বৈঠক, জনসভা কিংবা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে প্রচার যা করতে পারেনি তা আজ সম্ভব হয়েছে এই মেয়েগুলির জন্যই। পুরুলিয়ার জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ বললেন, “মিলিয়ে নেবেন, এই কিশোরী বাহিনীই আমার জেলায় বাল্যবিবাহ ও স্কুল ছাড়ার হার অনেক নামিয়ে আনবে।” লাগদা গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সঙ্গীতা দশ হাজার টাকা পুরস্কার পাওয়ার পরে হিন্দিতে সোজাসুজি রাষ্ট্রপতিকে বলল, “ভাবিনি কোনও দিন দিল্লি আসব। আপনি এক জন সাধারণ মেয়েকে দিল্লি ডাকলেন, আশীর্বাদ করলেন এই যথেষ্ট। আমরা আগামী দিনে দেশের হয়ে আরও কাজ করব।”
পুঁথিগত শিক্ষার অভাব, অপুষ্টির ছাপ মারা শরীরে এই মনের জোর আসে কী করে?
এই রহস্যের আজও তল পাননি পুরুলিয়া জেলার জাতীয় শিশুশ্রম বিভাগের অধিকর্তা প্রসেনজিৎ কুন্ডু। বললেন, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িতে দিদি-বউদি অথবা বন্ধুদের অল্প বয়সে বিয়ে হতে দেখেই এরা প্রতিবাদ শুরু করে। বিয়ে হলে পড়াশুনো বন্ধ হবে, এই ভয় থেকেই প্রতিবাদ করে।” বীণা-সঙ্গীতা-মুক্তির সঙ্গেই আজ গত বারের পুরস্কার-জয়ী আফসানা খাতুন এবং সুনীতা মাহাতোকেও পাঁচ হাজার টাকা দিলেন রাষ্ট্রপতি। |