দুঃখের দক্ষিণ
বড় গাড়ি কবে আসবে, পথ চেয়ে বসে থাকেন মুজিবরেরা
‘বড় গাড়ি’ রোজ আসে না। তাই হাটেই সব্জি ফেলে আসা শুরু করেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের মিরাজুল মোল্লা, দিলওসমান গায়েন, মুজিবর ঘরামিরা।
কিন্তু এখন আর তারও উপায় নেই। সব্জির দূষণ ঠেকাতে জরিমানার ব্যবস্থা চালু করেছে হাট কর্তৃপক্ষ। ঠিক হয়েছে, সব্জি ফেলে গেলে কিলোগ্রাম পিছু ১৫ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে চাষিদের। কয়েক বছর আগে রাগে, দুঃখে তাই নিজের হাতে ফলানো সব্জি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন ভাঙড়ের চাষিদের অনেকে। অতি উর্বর ভাঙড়ে ভাল ফলন হলেই মিরাজুলরা এখনও তাই সেই দিনগুলোর কথা মনে করে সিঁটিয়ে থাকেন।
উত্তর ২৪ পরগনার খিলকাপুরের থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে এলে ছবিটা এমনই উল্টে যাবে। এখানে ভাল ফলন হলে তাই লাভের কড়ি গোনার বদলে প্রমাদই গোনেন চাষিরা।
শোনপুর এলাকার চাষি মিরাজুল মোল্লা। খেত থেকে দেড়শো ফুলকপি তুলে বুধবার সকালে শোনপুরেরই হাটে গিয়েছিলেন তিনি। আশপাশের গ্রাম থেকেও ফুলকপি এসেছে। মিরাজুলের কপি মাপে একটু ছোট। ফড়েদের কাছে তাই ৭৫ পয়সা দরে কপি বেচে বাড়ি ফিরেছেন। বললেন, “ওই কপি যাদবপুর, বাঘাযতীন, গড়িয়া বাজারে ৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শোনপুর বাজারে ফড়েরা আমাদের কাছ থেকে ৭৫ পয়সায় কিনে পাইকারি বাজারে তা তিন টাকায় বিক্রি করে। প্রতি কপিতে ৫০ পয়সা লাভ রেখে পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরো বিক্রেতাকে বিক্রি করেন।” মিরাজুলের আক্ষেপ, “চারা, সার, দিনমজুর ও কীটনাশক নিয়ে প্রতি কপিতে খরচ পড়েছে প্রায় দু’টাকা। সারের দোকানে ধার হয়ে গিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। মোটর ভ্যানের ভাড়া বাবদ প্রায় হাজার টাকা এখনও বাকি। অথচ ফসলের দাম পাচ্ছি না। অন্য সবাই লাভ করছে। আমাদের শুধুই লোকসান!”
ফড়েদের মর্জিমতো দাম
হাটে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি
বাড়তি ফলনের গুনাগার

এ দিন বিকেলে ভাঙড়ের চন্দনেশ্বরের হাটে তিনশো কিলোগ্রাম বেগুন নিয়ে এসেছিলেন দিলওসমান গায়েন। তাঁর বাড়ি প্রায় ৪ কিমি দূরের বাকড়ি গ্রামে। ফড়েরা বেগুনের দাম দিয়েছে কেজি-প্রতি চার টাকা করে। দিলওসমান বলেন, “প্রতি কেজি বেগুন চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১২ টাকা। মহাজন টাকা পায়। ধার চড়ে যাচ্ছে। আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে!”
ওই হাটেই এ দিন নিজের খেতের দু’শো কেজি পালং শাক নিয়ে এসেছেন ধুপজালি এলাকার বাসিন্দা মুজিবর ঘরামি। ফড়েরা পালংয়ের দাম দিয়েছে কেজি-প্রতি আড়াই টাকা করে। মুজিবর বলেন, “এক কেজি পালং ফলাতে সব মিলিয়ে খরচ পড়ে সাড়ে তিন টাকা। ফড়েদের কথামতো বিক্রি করলে কেজি-প্রতি এক টাকা করে লোকসান গুনতে হবে।” কলকাতা-সহ শহরতলির বাজারে পালং ৬ থেকে ১০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফড়েরা কেজি প্রতি এক টাকা লাভ রেখে শহরের পাইকারি ব্যবসায়ীদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে ওই পালং। মিরাজুল বলেন, “সারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। অথচ শাকসব্জির দাম বাড়ছে না। ফড়েরা বলছে, বেশি দাম হলে সব্জি বিক্রি হবে না। অথচ কাগজে দেখি, কলকাতার বাজারে সব্জির দর আগুন। কিন্তু আমরা তো কিছুই পাচ্ছি না!”
ভাঙড় ১ ও ২ নম্বর ব্লক মিলিয়ে প্রায় ২০টি হাট রয়েছে। সব হাটেই ফড়েদের দাপট। তাদের মর্জির উপর নির্ভর করতে হয় চাষিদের। ওয়ালমার্ট বা টেস্কো-র মতো সংস্থার নামও শোনেননি মিরাজুল, দিলওসমান, মুজিবররা। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়েও বিশেষ কিছু জানেন না তাঁরা। কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পকর্তা দীপক পারেখ বা অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তাঁরাও মনে করেন, ফড়েদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা বড় সংস্থার কাছেই সরাসরি মাল বিক্রি করা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই তা শিখেছেন তাঁরা।
কী সেই অভিজ্ঞতা?
মিরাজুলরা জানান, কখনও-সখনও কলকাতা থেকে কোনও বড় হোটেল বা কেটারিং সংস্থা চাষিদের কাছ থেকে সব্জি কেনার জন্য হাজির হয় এলাকার হাটগুলিতে। তাদের সঙ্গে থাকে ‘বড় গাড়ি’। যে দিন ওই বড় গাড়ি হাটে ঢোকে, সে দিন হাসি ফোটে মিরাজুল, দিলওসমানদের মুখে। মিরাজুল বলেন, “যদি রোজ বড় গাড়ি এসে সব্জি কিনে নিয়ে যেত, তা হলে এ ভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে হত না। অতি ফলন হলেও আত্মহত্যা করতে হত না চাষিদের।”

ছবি: পিন্টু মণ্ডল



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.