সময় পেলেই দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ছেন ওঁরা। অনভ্যস্ত হাতে কালি দিয়ে লেখা পোস্টার। সঙ্গে ড্রাগ-বিরোধী স্লোগান। মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে ওঁরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছেন--‘মাদকনেশা সর্বনাশা, আপনারা কেউ নেশা করবেন না। নেশা নয়, আশাই মুক্তির পথ।’
যা শুনে মাথায় ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে সদর দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছেন মহিলারাও। বলছেন, “ঠিক কাজ, আরও বেশি করে প্রচার করো তোমরা। এতেও যদি বাড়ির মরদগুলোর একটু হুঁশ ফেরে!” ওঁরা ফাজিলনগর গ্রামের মর্নিং স্টার ক্লাবের প্রায় শ’খানেক সদস্য। পণ করেছেন, যে ভাবেই হোক গ্রামকে নেশামুক্ত করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরে জোর কদমে চলা এই প্রচারে সাড়াও মিলেছে। ক্লাবের ছেলেদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় জুম্মা মসজিদের ইমাম মৌলানা আব্দুল গনিও। তিনিও মসজিদ থেকে যতটা পারছেন সচেতনতার এই প্রচারে হাত বাড়িয়েছেন, কখনও মসজিতে নমাজের আগে বোঝাচ্ছেন। কখনও বা গ্রামের আনাচে কানাচে জমে ওঠা জটলায় মানুষের কাছে মাদক-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন। |
থানারপাড়ার ফাজিলনগর গ্রামে গত কয়েকবছরে নেশা করার প্রবণতা ব্যাপক বেড়েছে। মদ, গাঁজা, জুয়া তো ছিলই ইদানিং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে হেরোইনও। গ্রামের মানুষের অভিযোগ, সবকিছু জেনেও প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথের মত বসে রয়েছে। গ্রামের শেরফুল আনসারি বলেন, ‘‘এ দিকে নেশার কবলে পড়ে গ্রামের বহু মানুষ সর্বস্ব খোয়াচ্ছে। মারাও গিয়েছেন কয়েক জন। সংসারে অশান্তি বাড়ছে। কিন্তু প্রশাসনের ঘুম ভাহছে না।’’
এরপরেই এগিয়ে আসেন মর্নিং স্টার ক্লাবের সদস্যরা। দিন কয়েক আগে ক্লাবের সামনে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রায় হাজার দুয়েক গ্রামবাসী ও প্রশাসনের কিছু লোকজন নিয়ে তাঁরা একটি বৈঠকও করেন ক্লাবের সম্পাদক কুদ্দুস আলি সেখ। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ক্লাব সদস্যদের মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, কৃষক সব শ্রেণীর মানুষ আছেন। গ্রামের বহু যুবক আজ নেশায় ধুঁকছে প্রশাসনকে নানাভাবে জানিয়েও কিছু হয়নি। এই অবস্থায় তো আর চুপ করে বসে থাকা যায়না। তাই আমরাই নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করছি। কেউ যদি সত্যিই নেশা ছাড়তে চান, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, প্রয়োজন হলে আমরা চাঁদা তুলে তার চিকিৎসা করাব।’’
হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল ফাজিলনগর গ্রামের বছর ত্রিশের আব্বাসউদ্দিন আনসারি। পেশায় ভ্যানচালক ওই যুবক নেশা করার টাকা না পেয়ে মাঝে মধ্যেই বাড়ির নানা জিনিসপত্র বিক্রি করে দিত। দিন কয়েক আগে নেশা করার জন্য বাড়ির পোষা ছাগলটা সে বিক্রি করতে যাচ্ছিল। সেটা তার মা টুনুয়ারা বিবি দেখে ফেলেন। এরপর ছেলেকে তিনি বকাবকিও করেন। তার জেরেই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করে ওই যুবক।
ক্লাবের ছেলেরা প্রচার করতে করতে আব্বাসদের বাড়ির সামনে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই যুবকের মা টুনুয়ারা বিবি। বলেন,‘‘ ছেলেকে কত বার বলেছি ওই নেশা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিছুতেই কথা শুনতো না। ক্লাবের ছেলেরা যদি কয়েকদিন আগে থেকে এই প্রচারটা করত তাহলে আমার ছেলেটা হয়ত এ ভাবে মরত না।’’ ক্লাবের ছেলেদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন,‘‘ তোমরা প্রচারটা চালিয়ে যাও বাপধন আর কারো ছেলে যেন নেশার কবলে পড়ে এভাবে না মরে’’ ক্লাবের অন্যতম সদস্য তথা স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্বশিক্ষক আব্দুর রউফ আনসারি কিংবা ক্লাবের সভাপতি আশুতোষ মাহাতাদের কথায়,‘‘ ফাজিলনগর গ্রামে আগের থেকে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে গ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক বদলেছে কিন্তু এই নেশার কবলে পড়ে গ্রামের বহু মানুষ বিপথগামী হয়ে পড়ছেন।”
নারায়ণপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের রফিকুল ইসলাম বলেন,‘‘ গাঁজা, মদ, জুয়া, হেরোইন কারণে গ্রামের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। নেশার কারণে গ্রামে ছোটখাট চুরির ঘটনাও বাড়ছে। আমরাও প্রশাসনকে সমস্ত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য বলেছি তবে ক্লাবের ছেলেরা খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছে এতে সাড়াও মিলছে।’’
তেহট্টের মহকুমাশাসক অচিন্ত্যকুমার মণ্ডল বলেন,‘‘ক্লাবের ছেলেদের এই উদ্যোগ সত্যিই খুব প্রশংসনীয় আর ওই গ্রামে যারা এই মাদকের ব্যবসা করছে বা জুয়ার ঠেক চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নেবার জন্য বলা হচ্ছে।’’ তেহট্টের এসডিপিও মলয় মজুমদার বলেন,‘‘ওই গ্রামে যাতে মাদক দ্রব্য না ঢোকে ও কেউ যাতে জুয়া না খেলে সে ব্যাপারে পুলিশ কড়া নজর রাখছে।’’ |