চিত্রনাট্যটি আগেই রচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পুনর্নির্বাচন না চাহিয়া ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য শীর্ষ ক্ষমতার পদটি ছাড়িয়া দিবেন, আর পুতিন তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের গদিটি দিমিত্রির জন্য। টানা আট বছর বা দুইটি উপর্যুপরি মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যাইবে না, এই সাংবিধানিক বিধানটিকে এ ভাবেই পাশ কাটাইয়া পুতিন রাশিয়ার সর্বময় কর্তৃত্বে বহাল থাকিয়া যাওয়ার যে মৌরসি পাট্টা লইয়াছিলেন, রুশ জনসাধারণের তাহা ভাল লাগে নাই। গণতন্ত্রকে ব্যবহার করিয়া পুতিনের স্বৈরাচারী প্রবণতা চরিতার্থ করার অনৈতিকতায় ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। রুশ পার্লামেন্ট ডুমা’র নির্বাচনে সেই ক্ষোভ উগরাইয়া দিয়াছেন। পুতিন-মেদভেদেভের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি কোনও ক্রমে ভোটে জয়ী হইলেও তাহার সমর্থন ১৫ শতাংশ কমিয়াছে, ডুমায় দলের আসনসংখ্যাও কমিতেছে ৭৭টি।
এ বারের নির্বাচন অবাধও হয় নাই। দেশ জুড়িয়া ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠিয়াছে। নানা স্থানে ভোটাররা বিক্ষোভমিছিলও সংগঠিত করিয়াছেন। পুতিনের পুলিশ সেই সব বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করিলেও বিশ্বের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছাইয়া গিয়াছে যে, রুশ শাসকরা তাহাদের জার বা কমিউনিস্ট পূর্বসূরিদের মতোই গণতন্ত্রে ভিতর হইতে অন্তর্ঘাতে সচেষ্ট। পুতিনের ক্রিয়াকলাপে সবচেয়ে লাভবান হইতেছে কমিউনিস্টরাই। সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন হইলেও কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ায় নিষিদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার যাবতীয় সুযোগসুবিধাই তাহারা গ্রহণ করিতে পারে, করিয়া থাকে। সেই সূত্রেই বহুদলীয় নির্বাচনব্যবস্থায় তাহাদের অংশগ্রহণ। এ বার ডুমা’য় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা ৫৭ হইতে বাড়িয়া ৯২-এ পৌঁছিয়াছে। তবে কমিউনিস্টদের বর্ধমান জনপ্রিয়তা নয়, পুতিনের নীতি ও শাসনপ্রণালীর বিরুদ্ধে ক্ষোভই এই ফলাফল সম্ভব করিয়াছে। পুতিন যে ভাবে দেশ চালাইতেছেন, তাহাতে ধনী বনাম দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমে বাড়িতেছে। দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ প্রকাশ্য এবং বেপরোয়া। কাস্পিয়ান বেসিনের উৎকৃষ্ট তৈলভাণ্ডার রুশ অর্থনীতিতে যে-জোয়ার প্রবাহিত করিয়াছিল, সঠিক পরিচালনার অভাব এবং ইউরোপের সহিত দরকষাকষির হাতিয়ার রূপে ওই সম্পদের লেনদেন সেই সমৃদ্ধি হইতেও জাতীয় অর্থনীতিকে বঞ্চিত করিয়াছে। সংগঠিত অপরাধচক্রের সহিত জড়িত চোরাচালানকারীরা একচেটিয়া শিল্পপতি হিসাবে জাঁকাইয়া বসিয়াছে। গণতন্ত্রকে ব্যবহার করিয়া স্বৈরাচারী যেমন অনন্ত কাল আপন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখিতে পারে, তেমনই গণতন্ত্র তলে-তলে স্বৈরাচারের সামাজিক ভিত্তি ক্ষয় করিয়া দিতে পারে। আরও আট বছর ধরিয়া পুতিনকে রাষ্ট্রনায়ক রূপে দেখিবার ক্লান্তিও ভোটারদের বিরূপ করিয়া থাকিতে পারে। পুতিন সোভিয়েত গোয়েন্দা-চক্র কেজিবির প্রধান ছিলেন। অসংখ্য চর নিয়োগ করিয়া দেশবাসীর মতিগতি বোঝা এবং সম্ভাব্য বিরোধীদের ষড়যন্ত্র ধ্বংস করার স্তালিনবাদী পন্থাপ্রকরণ তাঁহার করায়ত্ত। তথাপি তিনি জনসাধারণের মেজাজ বুঝিতে ব্যর্থ। ক্ষমতালিপ্সা এ ভাবেই ক্ষমতাবানকে অন্ধ করিয়া দেয়। তখন শুধু ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও গণমাধ্যম-লালিত ভাবমূর্তির উপর ভরসা করিয়া শাসন চালাইতে হয়। গণতন্ত্র পুতিনকে সেই সুযোগ যেমন দিয়াছে, তেমনই গণতন্ত্রই আবার ডুমা’য় কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাইয়া চলিয়াছে। যে-গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করিয়া কমিউনিস্টরা একদিন রাশিয়ায় জারতন্ত্রের উত্তরাধিকার প্রলম্বিত করিয়াছিলেন, নয়া-জার হইতে উদ্যত ভ্লাদিমির পুতিনকে যদি সেই গণতন্ত্রের কারণেই বিদায় লইতে হয়, তবেই হয়তো রাশিয়া হইতে জারের জমানার চূড়ান্ত অবসান হইবে। |