বড়বাজারের গীতা কাটরায় কাপড়ের ব্যবসা আছে বাবা ভানু মিশ্রের। তিনি বিজেপি-র কলকাতা উত্তর-পশ্চিম জেলা কমিটির প্রাক্তন সভাপতিও। কিন্তু তাঁর ছেলে আনন্দ মিশ্র ‘গরিব এবং বেকার’! তাই কলকাতা পুরসভার একশো দিনের কাজের প্রকল্পে নিকাশি বিভাগে কাজ পেয়েছেন আনন্দ।
দীপক ওঝার দাদা ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর বিজয় ওঝা। তাঁদেরও পারিবারিক ব্যবসা আছে। টেরিটি বাজারে দোকান। অথচ দীপকও ‘গরিব এবং বেকার’! তিনিও তাই কলকাতা পুরসভার ওই প্রকল্পে বস্তি বিভাগে কাজ পেয়েছেন।
শুধু এই দু’জনই নন। অভিযোগ যথেষ্ট ‘সম্পন্ন’ হওয়া সত্ত্বেও কলকাতা পুরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে দু’জন, উদ্যান বিভাগে তিন জন, পুকুর-সাফাই বিভাগে তিন জন, বস্তি বিভাগে চার জন এবং নিকাশি বিভাগে পাঁচ জন একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন। অথচ, নিয়মানুযায়ী, ওই প্রকল্পে শহুরে গরিব বেকারদের কাজ পাওয়ার কথা। অভিযোগকারী জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ)-এর সাধারণ সম্পাদক যশোবন্ত সিংহ। যিনি তথ্যের অধিকার আইনের বলে ওই সমস্ত তথ্য জোগাড় করেছেন।
পুরসভা সূত্রে খবর, ওই প্রকল্পে গরিবের ‘সংজ্ঞা’ স্পষ্ট করা নেই। আইনের সেই ফাঁক গলেই চলছে দেদার জালিয়াতি। তবে এ কথা মানতে চাননি কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “একশো দিনের কাজ পাওয়ার কথা বিপিএল কার্ডধারীদের। কিন্তু পুরসভার করা বিপিএল তালিকা এখনও অসম্পূর্ণ। তাই কাউন্সিলরদের উপরেই আমরা নির্ভর করি এ ব্যাপারে। তাঁরা যাঁদের নাম সুপারিশ করেন, তাঁদের কাজ দেওয়া হয়।” পুরসভা সূত্রের খবর, বরোর নোডাল অফিসারদের কাছে ওই প্রকল্পে কাজের আবেদন জমা পড়ে। তাঁরা সেগুলি বরো কমিটির কাছে পাঠান। বরো কমিটিই প্রাপক তালিকা তৈরি করে। অন্য দিকে, পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী রূপা বাগচীর বক্তব্য, “আমরা বলেছিলাম, খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকল্পে লোক নেওয়া হোক। এ ভাবে চুপিচুপি লোক নিলে অন্যায়ের সুযোগ তো থাকবেই।”
যশোবন্তের অভিযোগ, আনন্দ, দীপক-সহ ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের যত জন ‘সম্পন্ন’ পরিবারের হয়েও ওই প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন, সকলেই বিজেপি সমর্থক ও কাউন্সিলর বিজয়বাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’। যশোবন্ত বিষয়টি নিয়ে আগামী দিনে আদালতেরও দ্বারস্থ হবেন। তাঁর কথায়, “বিজয় ওঝার হয়ে আমি পুরভোটে প্রচার করেছিলাম। এখন দেখছি, যাঁকে জেতালাম, তিনি অন্যায় ভাবে অনেককে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দিচ্ছেন। গরিবের জন্য নির্ধারিত সরকারের টাকা বড়লোকদের পিছনে ব্যয় হচ্ছে।”
বিজয়বাবুর অবশ্য সাফাই, “আমরা কাউন্সিলররা ওই কাজ দেওয়ার অধিকারী নই। আমরা বড়জোর সুপারিশ করতে পারি বা কখন লোক নেওয়া হবে, তা স্থানীয় মানুষকে জানাতে পারি। সুতরাং, কারা কেন ওই কাজ পেয়েছে, আমি বলতে পারব না।” কিন্তু তাঁর ভাই দীপক কি গরিব বা বেকার? বিজয়বাবুর জবাব, “কাউন্সিলরের ভাই কি গরিব বা বেকার হতে পারে না? আর এখন ও অন্যত্র কাজ পেয়ে যাওয়ায় পুরসভার কাজটা ছেড়ে দিয়েছে।” আর আনন্দের বাবা তথা বিজেপি-র কলকাতা উত্তর-পশ্চিম জেলা কমিটির প্রাক্তন সভাপতি ভানুবাবুর কথায়, “আমার ছেলেকে আমি দেখি না।” বিজয়বাবুর বক্তব্য, “বাবা দেখেন না বলেই আনন্দ ওই প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “কাজ না করে কেউ টাকা নেননি। কাজ করেই টাকা নিয়েছেন।” কিন্তু, বড়বাজারের ব্যবসায়ীর ছেলে বা কাউন্সিলরের ভাইকে এখনও স্বহস্তে নর্দমা বা বস্তি সাফ করতে দেখেননি এলাকার বাসিন্দারা।
বস্তুত, বিজয়বাবুর ‘তাত্ত্বিক’ অবস্থান, যাঁদের পারিবারিক রোজগার মাসে ১০ হাজার টাকা বা তার কম, তাঁদের সকলেরই একশো দিনের কাজের প্রকল্পের আওতায় আসা উচিত। কারণ, বর্তমান বাজারদরের প্রেক্ষিতে ওই পরিমাণ পারিবারিক রোজগার থাকলেও সংসার চালাতে নাভিশ্বাস ওঠে। বিজেপি-র ওই কাউন্সিলর বলেন, “বড়বাজারে বাড়ি এবং ব্যবসার মালিককে সকলে বড়লোক ভাবে। কিন্তু সেখানে দশ লক্ষ টাকা দামের বাড়িতে এমন মানুষও থাকেন, যাঁর কোনও আয় নেই। তাঁর কি গরিব-বেকারের তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত নয়? বড়বাজারে দিনে ২০০ বা ৩০০ টাকার কম আয় করে, এমন লোক প্রায় নেই। তাঁদেরও সংসার চালাতে অসুবিধা হয়। তাই তাঁদেরও গরিব বেকার হিসেবে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ পাওয়া উচিত।”
প্রশ্ন হল, পুরসভা তাঁর যুক্তি গ্রহণ করে বিধি না-বদলালে কি তিনি সম্পন্ন গৃহস্থের সন্তানকে ওই প্রকল্পে কাজ ‘পাইয়ে’ দিতে পারেন? বিজয়বাবুর ফের সাফাই, “আমি তো দিইনি। বরোর নোডাল অফিসার দিয়েছেন। আর আইন যা-ই বলুক, নীতিগত ভাবে আমি পরিষ্কার।” |