|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
পরিবারতন্ত্র: এই দেশে, এই বঙ্গে |
পরিবারতন্ত্রের কতগুলি অমোঘ অনুশাসন নিজের থেকেই যেন কাজ করে। হয়তো
পরিবারের প্রধানরা নিজেরাও জানতে পারেন না। ইতিহাসের পাতা উলটেছেন অশোক মিত্র |
সেই রামায়ণ-মহাভারতের যুগ থেকে রাজারাজড়ার দেশ ভারতবর্ষ। সিংহাসনে সমাসীন মহামহাশয়দের অভিভূত শ্রদ্ধা জানাতে ভারতবাসী ইতিহাসের অধ্যায়ের পর অধ্যায় পেরিয়ে এসেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, সুখচিত সংবিধানে এমনকী এটাও পরে সংযোজিত, এই দেশ শুধু গণতন্ত্রই নয়, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। অথচ সেই সঙ্গে সামন্তবাদও অব্যাহত। ষাটের দশকে জাতীয় দল ইন্দিরা গাঁধীকে যখন বরণ করে নিল, তখন কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না ইতিহাসের ধারা কোন খাতে বইবে। তাঁর জমানার প্রথম পর্বে প্রশাসনে ঈষৎ অনভিজ্ঞ ইন্দিরা বেশ কয়েকটি বছর হাবুডুবু খেয়েছেন। আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাসে স্থিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে যুগপৎ কূটকৌশল ও দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দলে এবং দলের বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দ ক্রমশ কুপোকাত। ভাগ্য ইন্দিরার উপর সদয় থেকেছে। পূর্ব পাকিস্তানের গণ অভ্যুত্থান যে পরমাশ্চর্য সুযোগ এনে দেয়, তার সুচারুতম ব্যবহার তিনি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে ঘোল খাইয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সৈন্য-সাহায্য করে বিশ্ব জুড়ে তারিফ কুড়িয়েছেন। এমনকী দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা পর্যন্ত তাঁকে সাক্ষাৎ মা ভগবতী বলে বন্দনাও করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই ইন্দিরা গাঁধীর আচরণে-বিচরণে অন্য এক প্রবণতার লক্ষণ। অহংকার, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, পরমত-অসহিষ্ণুতা, এঁকে ওঁকে তাঁকে অবিশ্বাস, সর্বদা স্তাবকদের ঘেরাটোপে থাকা, অথচ জাত চাটুকারেরাও বুঝে উঠতে পারেন না, কবে তিনি সহসা কুপিত হয়ে তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলবেন। এর পর অতি দ্রুত ঘটনাবলির পরম্পরা: দেশ জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি, জমে ওঠা জনরোষের সংগঠিত ব্যাপ্তি, ইলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায়, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ইন্দিরা গাঁধী স্বৈরাচারিণী রূপে সংস্থিতা। সেই সূত্র ধরে পরিবারতন্ত্রের নিটোল আত্মপ্রকাশ। ওই উথালপাথাল বছরগুলিতেই ইন্দিরা গাঁধী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন নিজের সন্তানদের ছাড়া আর কারও উপর আস্থা স্থাপন করা যায় না। প্রয়োজনমাফিক ক খ গ কিংবা ঘ-কে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু তাঁদের বিশ্বাস করা ভুল। নির্ভরতার একমাত্র পাত্র, সঙ্কটে একমাত্র ভরসা আত্মজ-আত্মজারা। পরের ইতিহাস তো সকলের জানা। নানা দুর্দৈবের মধ্য দিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত এখনও কংগ্রেস প্রধান শাসক দল। সেই দলে নেহরু-গাঁধী পরিবারই প্রথম ও শেষ কথা। ইন্দিরা গাঁধী নিধনের পর তাঁর জ্যেষ্ঠ তনয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নিধনের পর বিবিধ ঝড়ঝাপটা সামলে কংগ্রেস ফের রাষ্ট্রশাসনের চূড়ান্ত দায়িত্বে। এই মুহূর্তে দল থেকে যদিও এক জনকে প্রধানমন্ত্রীর বকলমা দেওয়া হয়েছে। আদতে সমস্ত প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দলের সভানেত্রী ইন্দিরা-পুত্রবধূর এক্তিয়ারে এবং দলের ভিতরে অন্তত সবাই মেনে নিয়েছেন। দু’চার দিনের প্রতীক্ষা, তার পরেই ইন্দিরা গাঁধীর পৌত্র ভারতবর্ষের রাজসিংহাসনে বৃত হবেন। |
|
উত্তরাধিকার। আশুতোষ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। |
ভাবী ইতিহাস কী বলবে, ভাবী ইতিহাসই জানে। কিন্তু গুরুবাদী দেশ আমাদের। কেন্দ্রে যে পরিবারতন্ত্র, তা এখন রাজ্যে রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোন রাজ্য ছেড়ে কোন রাজ্যের নাম করব। পঞ্জাবে প্রবেশ করুন, কিংবা উত্তরপ্রদেশে অথবা ওড়িশায়, নয়তো ও দিকে অন্ধ্রপ্রদেশে বা তামিলনাড়ুতে বা কর্নাটকে বা মহারাষ্ট্রে, এবং অবশ্যই রাজস্থানে। যে দল ক্ষমতায় আসীন বা যারা প্রতিপক্ষ, সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র বিস্তার। জীবনানন্দের একটি কবিতায় এই পঙ্ক্তিটি বিরাজ করছে ‘আমাদের সন্তানেরা জ্যেষ্ঠ হয়ে যাবে স্বতঃসিদ্ধতার মতো জীবনের ভিতরে দাঁড়াবে’ তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যার যেন মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
অথচ কী আশ্চর্য, আমাদের বঙ্গদেশে এমনটা ঘটেনি, যদিও ঘটবার এককাঁড়ি যৌক্তিকতা ছিল। রাজা ও নবাবদের পর্বাপর্বের শেষেও এখানে দুশো বছরের উপর ইংরেজ প্রভুরা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করেছিলেন, তার কারণে গণ্ডা গণ্ডা জমিদার বংশের পরাক্রম, উত্তরাধিকার সূত্রে বংশধররা পিতৃকুলের সম্পত্তি নিশ্চিন্ত ভোগ করে এসেছেন। নির্বিচারে প্রজাপীড়নে কখনও-সখনও সিদ্ধহস্ত হয়েছেন, বা ঔদার্য-দাক্ষিণ্য বিতরণ করেছেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই ধমনীতে সেই ভূম্যধিকারীদের রক্তের ছিটেফোঁটা অবশ্যই বহমান ছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তবু পরিবারতন্ত্র আদৌ আমল পায়নি। এমনকী এলগিন রোড, উডবার্ন পার্ক জড়িয়ে যে দক্ষিণ রাঢ়ীভুক্ত বসু পরিবার, স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁর সর্বত্যাগী ভূমিকা, নেহরু পরিবারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, সেই পরিবার থেকে একজন, দু’জন হয়তো সংসদ বা বিধানসভায় যাওয়ার জন্য ভোটে লড়েছেন, হয়তো সফলও হয়েছেন, দৌহিত্র সম্পর্কিত একজন অতি সম্প্রতি রাজ্যমন্ত্রীও হয়েছেন, কিন্তু ওই পর্যন্ত। একদা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অধ্যুষিত ভূখণ্ডেই গণতন্ত্রের প্রায় নিটোল প্রস্ফুটন। মাত্র একটি ক্ষেত্রে, শিক্ষাজগতে, পরিবারতন্ত্র স্থিত হওয়ার সম্ভাবনা বলুন, আশঙ্কা বলুন, বঙ্গভূমিতে দেখা দিয়েছিল। তবে তা ধোপে টেকেনি। দ্বিতীয় প্রজন্মেই সেই পরিবারতান্ত্রিক পরীক্ষার ইতিও ঘটে। বাংলার ব্যাঘ্র বলে এখনও খ্যাত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রথম দুই দশকে অখণ্ড বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ামক ছিলেন। বিদেশি শাসকরাও বরাবর তাঁর সঙ্গে সশ্রদ্ধ সহযোগিতা করেছেন। বড় জটিল চরিত্রের মানুষ ছিলেন এই প্রবাদপুরুষ। প্রখর মেধাসম্পন্ন, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিবিধ শাখা-প্রশাখায় বিহারবিলাসী, গণিতশাস্ত্রের গভীর ব্যুৎপত্তি, পাশাপাশি মস্ত আইনজ্ঞ। বহু বছর ধরে কলকাতা হাইকোর্টের সম্মানীয় বিচারপতি। সেই সঙ্গে একাধিক বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। যখন তিনি উপাচার্য নেই, কিছু যায়-আসে না, তিনিই স্থির করেন কে উপাচার্য হবেন, বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক বাছাই করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষক বা পরীক্ষা ব্যবস্থার পরিচালক কে হবেন তাও স্যর আশুতোষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন মস্ত বড় সাম্রাজ্য। ব্রহ্মপুত্র থেকে অসম, বিহার, ওড়িশা পর্যন্ত প্রবেশিকা পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। যাকে বলা হত দু’বছরের ইন্টারমিডিয়েট পাঠক্রম, তারও। বাংলাদেশের কলেজসমূহ পর্যন্ত পুরোপুরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। অবশ্য সেই সঙ্গে উত্তর-স্নাতক স্তরের ও গবেষণার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের তাই প্রায় অসীম ক্ষমতা। স্বয়ং উপাচার্য না-থাকলেও যিনিই থাকুন না কেন, তাঁকে অঙ্গুলিহেলনে পরিচালনা করতেন স্যর আশুতোষ, দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী।
সেই প্রতাপের অপব্যবহারও নেহাত কম হয়নি। এখানে-ওখানে প্রায়ই স্বৈরাচার প্রকট হয়েছে। অথচ এই মানুষটির অন্য দিকগুলি ভুলে থাকি কী করে? প্রচণ্ড বিদ্যোৎসাহী, বাঙালিদের যে করেই হোক লেখাপড়া শেখাবেন, শেখাবেনই। বঙ্গসন্তানদের স্নাতক হওয়ার সংখ্যা যাতে প্রতি বছর হু-হু করে বেড়ে যায় তার জন্য তাঁর বিনিদ্র রাত্রিযাপন (বুদ্ধদেব বসুর অতি তরুণ বয়সে লেখা তখন অতি কুখ্যাতি কুড়ানো ‘যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন’ নামে একটি গল্পে বড়লোক বাবার প্রমোদে ভেসে যাওয়া নন্দনের একটি মন্তব্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি, ‘আশু মুখুজ্জে যতই চেষ্টা করুন আমি বাপু বি এ ডিগ্রি ফিগ্রি নিতে পারবো না’।) তাঁর জ্ঞানচর্চার উৎসাহ এত গভীর যে, দেশের এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে প্রতিভার সন্ধান করে বেড়াতেন। কারও খোঁজ পেলে আদর করে কলকাতায় আমদানি করে অধ্যাপনায় অথবা গবেষণায় গুঁজে দিতেন। যেমন দিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামনকে কিংবা সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনকে। রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু, মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে স্বভাব-তাচ্ছিল্যবোধ, অথচ মুহম্মদ শহীদুল্লাহের কদর যথার্থ বুঝতে পেরেছিলেন।
শৈশবে আশুতোষ সম্পর্কে প্রথম যে কাহিনি শুনি, তা এক দিকে যেমন তাঁর দয়ালুতা ও ঔদার্যের পরিচায়ক, অন্য দিকে তাতে দুরাচারেরও আভাস। ঢাকা কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের এক ঢিলেঢালা অধ্যাপক আই এ পরীক্ষায় বসা পাঁচশো না হাজার পরীক্ষার্থীর এক বান্ডিল খাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দফতর থেকে নিয়ে শিয়ালদা থেকে ঢাকা মেলে চাপলেন। অন্ধকার থাকা অতি প্রত্যুষে গোয়ালন্দে ট্রেন থেকে নেমে ঝাঁকামুটের মাথায় খাতার মস্ত বান্ডিল চাপিয়ে নারায়ণগঞ্জগামী জাহাজ ধরার জন্য জেটিমুখো। জেটিতে প্রচণ্ড ভিড়, ধস্তাধস্তি, মুটের মাথা থেকে খাতার বান্ডিল থেকে ঝটকে পড়ে স্রোতে-ফোঁসা পদ্মার অতলে বিলীন। ভীতসন্ত্রস্ত অধ্যাপকটির গোয়ালন্দ থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, কাঁদতে কাঁদতে স্যর আশুতোষের দ্বারস্থ। মস্ত বড় মানুষটি অধ্যাপকের কাঁধে-মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামালেন। কোনও চিন্তা নেই, তিনি ব্যাপারটি দেখবেন। অধ্যাপকটিকে কলকাতায় আটকে রাখলেন। তাঁর কলেজ থেকে স্বাস্থ্যহানির কারণে দীর্ঘ ছুটির ব্যবস্থা করলেন। মধুপুরে মুখোপাধ্যায় পরিবারের সুবৃহৎ বাসগৃহ খালি পড়ে আছে। সপরিবার অধ্যাপককে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। যথাসময়ে পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গেল। কী করে এই ভোজবাজি সম্ভব হল, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের দুটো লক্ষণই দৃষ্টান্তিত হল। একনায়করা পরম উদার হতে পারেন, সেই সঙ্গে বিন্দুমাত্র চিন্তা না-করে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো-কমানো নিয়ে যে-সমস্ত কাহিনি ইদানীং শোনা যায়, তা কি বিশ্রুতকীর্তি স্যার আশুতোষের আমলেই শুরু হয়নি?
আরও যে গল্পটি সেই বালক বয়সে কানে এসেছিল, তার তাৎপর্য আরও ভয়ঙ্কর। আশুতোষের দ্বিতীয় পুত্র শ্যামাপ্রসাদ অবশ্যই বরাবর প্রতিভাবান। তবে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ছাত্র থাকাকালীন তিনি প্রতিটি ক্লাসে দ্বিতীয় হতেন। বরাবর অন্য এক জন প্রথম হতেন। অথচ প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্ত ব্যাপ্তি জুড়ে যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। স্কুলে বরাবর প্রথম হওয়া সেই ছাত্রটিও অবশ্য খুব ভাল ফল করেছে। কিন্তু এই প্রথম বার তিনি দ্বিতীয়। শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর সেই সহপাঠী প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। শীতের মন্থর দুপুর। কলেজের বিস্তীর্ণ মাঠে স্কুলের সেই সহপাঠীকে মধ্যমণি করে ছাত্রদের জমাটি আড্ডা। দেখা গেল একটু দূরে শ্যামাপ্রসাদ একা একা ঈষৎ অসহায় ভাবে হাঁটছেন। মধ্যমণি সেই উজ্জ্বল সহপাঠীটি তাঁকে সোচ্চারে আহ্বান করলেন: ‘এসো, এসো শ্যামাপ্রসাদ, ফার্স্ট হয়েছ তাতে লজ্জার কী আছে!’
প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম না হয়ে অন্য কিছু হলেও জীবনের উত্তর-পর্বে শ্যামাপ্রসাদের ধারাবাহিক সাফল্য আটকে যেত না। বাগ্মিতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা হেতু তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই স্বমহিমায় বিরাজ করতেন। কিন্তু পরিবারতন্ত্রের কতগুলি অমোঘ অনুশাসন নিজের থেকেই যেন কাজ করে। হয়তো পরিবারের প্রধানরা নিজেরাও জানতে পারেন না। কিন্তু সান্ত্রী অমাত্যরা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝে নেন কী করণীয় এবং হয়তো এই কারণেই আশুতোষের পরিবার সাম্রাজ্য দ্বিতীয় প্রজন্মেই বিলুপ্ত হল। আশুতোষের প্রয়াণের পরেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিবারের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। বছর দশেক বাদে স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ উপাচার্য হয়েছিলেন। আরও এক দশকের ব্যবধানে উপাচার্যের আসনে বসলেন আশুতোষের অন্যতম জামাতা প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অঘটন ঘটল প্রমথনাথের মেয়াদকালে। তখন কলকাতায় ট্রামে-বাসে যে গল্পটা রটেছিল, যার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের উপায় নেই: উপাচার্যের এক পুত্র এম এ পরীক্ষায় বসেছেন, পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণির নম্বর পেয়েছেন, সব মিলিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হননি। বেচারা উপাচার্য কিছুই জানতেন না। তাঁর সন্তানটিও না। সন্তানজননী আশুতোষ-দুহিতা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিভাগের খোদ কর্তাকে বাড়িতে ডেকে মুখঝামটা দিয়েছিলেন, ‘বড়বাবুর ছেলে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হতে পারে, মেজবাবুর ছেলেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হতে পারে, আমার ছেলের বেলায় শুধু প্রথম শ্রেণি? এর বিহিত করুন!’ অনুগত ভদ্রলোক আদেশ মেনে বিহিত করলেন একটা-দুটো পেপারে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হল, আশুতোষ-দৌহিত্র প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হিসেবে ঘোষিত হলেন। কলিকাল! বাঙালি মধ্যবিত্ত পুথি পড়ে গণতন্ত্রের বিধিবিধান নিয়মকলা সদ্য শিখেছেন। ব্যাপারটি চাপা রইল না। ঢিঢিক্কার! প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর জন্য সংবাদপত্রগুলির পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। ন’টে গাছটি মুড়োল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবারতন্ত্রের ধপাস পতন।
তবে যে গতিতে বাঙালিরা আপাতত জাতীয়তার চেতনাসম্পন্ন তথা বিশ্বায়িত হচ্ছেন, কে জানে, পরিবারতন্ত্রের অভ্যুদয়ও আর খুব বেশি দিন হয়তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্তত ব্যক্তিতন্ত্র। |
|
|
|
|
|