প্রবন্ধ ২...
জনপ্রিয়তা বনাম গণতন্ত্র
ংসদ ভবনে প্রবেশ করলেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি। তাঁর হাতে একটি বই। লেখক বিল কুইন। বইটির নামের অর্থ: ওয়ালমার্ট কী ভাবে আমেরিকা এবং গোটা পৃথিবীর সর্বনাশ করল। দিনান্তে আবার দেখা বিজেপির এই আধুনিক নেতাটির সঙ্গে। বাড়ি ফিরছেন। তখনও কিন্তু তাঁর হাতে সেই বইটি। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে অরুণ জানালেন, এই বইটি কিন্তু আমার পড়া। তা সত্ত্বেও কেন এটিকে আমি বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি জানো? যাতে আম-জনতা জানতে পারে অরুণ জেটলি এই বইটি পড়ছে।
অরুণ জেটলি সংস্কারবাদী। এন ডি এ জমানায় তিনি বিলগ্নিকরণ মন্ত্রী ছিলেন। বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের এক মস্ত বড় প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ভিতরে-ভিতরে খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি বিলগ্নিকরণের পক্ষে তিনি। কিন্তু এ দেশে অর্থনীতি আর প্রশাসনিকতার সঙ্গে বিষম বিরোধ বেধেছে রাজনীতির। সঙ্ঘ পরিবারের ফরমানের বিরোধিতা করতে হবে। অতএব জয় হোক বিরোধিতার রাজনীতির। শুধু অরুণ জেটলি অথবা বিজেপি বলে নয়। গোটা দেশের সব প্রান্তেই এখন শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক জনপ্রিয়তাবাদের রাজনীতি। কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত বলে আপনি মনে করছেন সেটি বড় কথা নয়। কোনটা সাধারণ মানুষ ঠিক কাজ বলে মনে করবে সেটি ভেবেই আপনাকে চলতে হবে। সেই ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাজনৈতিক নেতা অথবা দল তার ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চায়। এমনও হতে পারে, আমি রাজনৈতিক নেতা হিসাবে হয়তো ভাবছি এ ব্যাপারে অমুক অবস্থান না নিলে আমার ভোট ব্যাঙ্ক বিগড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ তার বিপরীত হতে পারে। আমজনতার মন বুঝতে অনেক সময় জনবিচ্ছিন্ন নেতারাও ভুল করেন। পরমাণু চুক্তির সময় দেখেছি নয়াদিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে শাসক দল ও সরকারের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল এক তুমুল বিতর্ক। কংগ্রেস নেতাদের কারও কারও ধারণা হয়েছিল আমেরিকার সঙ্গে এই চুক্তি করার ফলে গোটা দেশে সংখ্যালঘু ভোট বেঁকে বসবে। মধ্যবিত্ত জনসমাজে বিদ্রোহ হবে। মনমোহন সিংহ কিন্তু গোঁ ধরে সে দিন কংগ্রেসকে তাঁর ভাবনায় চলতে বাধ্য করেছিলেন। ভোটের ফলাফলে কিন্তু দেখা গেল মানুষ কংগ্রেসকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ তো করেইনি, উল্টে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা বহু বছর পরে দু’শো অতিক্রম করল।
আশীর্বাদ না অভিশাপ? যা ভাবছেন, সেটাই বলুন না!
জনগণেশের দাক্ষিণ্য পেতে এই যে জনপ্রিয় রাস্তায় হাঁটার রাজনৈতিক প্রবণতা, তার একটি ভয়ংকর প্রতিযোগিতামূলক দিক আছে। রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা মানেই সেই রেলমন্ত্রী জনগণ-বিরোধী। রেলের ভাঁড়ারে অর্থ সংকট, রেলের ভাড়া না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে রেল চালানো যে আসলে সাধারণ মানুষেরই আর্থিক লোকসান, সেটি কে বোঝাবেন? শাসক দল যদি ভাড়া বাড়ায় তা হলে সমস্ত বিরোধী দল তার বিরোধিতা করবে। অতএব বিরোধিতার পালের বাতাস কাড়তে গেলে আপনি বলুন, ‘আমি ভাড়া বাড়াব না।’ রাজ্যস্তরেও সেই একই দৃশ্য পট। আপনি বলুন, ‘বাজেটে মানুষের উপর কর চাপাব না। পুরসভা জলকর বসাবে না।’ দাতব্যমূলক রাজনীতিকে অনুসরণ করুন। এটাই খায়! আর আপনি যদি উচিত কথা শোনাতে যান তা হলেই আপনি একঘরে। কারণ অন্যরা সবাই একই ভাবে জনপ্রিয়তার রাজনীতি করছেন। নীতীশ কুমার থেকে লালুপ্রসাদ যাদব, লালুপ্রসাদ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেল মন্ত্রকে এই ট্র্যাডিশনই সমানে চলেছে।
মানুষের মন পাওয়ার চেষ্টা রাজনীতিতে নতুন নয়। সে তো নেহরুর সময় থেকেই আমরা দেখে আসছি। দুঃস্থ, গরিব শিশুকে সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোলে তুলে নিচ্ছেন তাঁর ধোপদুরস্ত জামাকাপড়ের কথা না ভেবেই। জনসভার মঞ্চ থেকে নেমে বেড়া ডিঙিয়ে ইন্দিরা গাঁধী মানুষকে ছুঁতেন। সে সবই ছিল জনসংযোগ কর্মসূচি। ক্ষমতায় আসার পর নেহরুকে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল দিল্লির এক সংবাদপত্রে। সেটিতে ছিল দুই নেহরু। প্রথম নেহরু জনপ্রিয় ঘোষণার এক বিরাট স্তম্ভের উপর বসে রয়েছেন। আর দ্বিতীয় নেহরু মাত্র ছয় মাস পরে সেই বিরাট স্তম্ভটিকে কাঁধে নিয়ে ন্যূব্জ হয়ে হাঁটছেন। জনপ্রিয় হতে তাই সে দিনও চেয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতিতে এখন শুধু জনসংযোগের কর্মসূচি নয়, এখন চলছে ভাবমূর্তি অথবা ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাকুল প্রয়াস। বোঝাতে হবে আমি তোমাদেরই লোক। আর এই পটভূমিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রবলপরাক্রান্ত সর্বভূতে বিরাজমান মিডিয়া। বিস্ফোরণের পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিল পোশাক বদল করেছিলেন বলে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। মোহনদাস গাঁধী যদি স্বাধীনতার পরে ঘোষণা করতেন, ‘এ বার আমি ধুতি ছেড়ে কোট-প্যান্ট পরব’ তা হলে কী হত? আজও মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই কারণে নীল হাওয়াই চটি ও সাদা শাড়ি ছাড়তে পারেন না। তবে এ সবই হল ব্র্যান্ড পারসেপশন-এর একটি প্রতীকী দিক। ছাত্রজীবনে আমরাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থ্রি-পিস স্যুট পরা দর্শনের অধ্যাপককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারতাম না। কাঁধে ঝোলা চটি পরিহিত অধ্যাপককে বেশি দার্শনিক মনে হত।
পোশাক বাহ্য। যেখানে মূল প্রশ্নটি নীতি এবং আদর্শের সেখানে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যদি ঠিক এবং উচিত হয় তবে সেটি জনগণ-বিরোধীই বা হবে কেন? যদি এক জন রাজনৈতিক নেতা বিশ্বাস করেন যে খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি লগ্নি এলে তাতে কৃষকের উপকার হবে তবে সেটিকে লুকিয়ে মানুষ ভোট দেবে এই অঙ্কে তার বিরোধিতা করবেন কেন? বরং সেই নেতার তো বড় দায়িত্ব থাকে মানুষের কাছে গিয়ে বোঝানোর যে, এই সিদ্ধান্ত জনবিরোধী নয়, ‘পাবলিক’-এর স্বার্থে। ’৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে মানুষের মন জয় করতে বিধবা ভাতা, বেকার ভাতা চালু করেছিল। আজ এত বছর পরে সম্ভবত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও একান্তে স্বীকার করবেন, ওটি সুষ্ঠু অর্থনীতি ছিল না। সমস্যা হচ্ছে, যাবতীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব এ দেশে শুধু শাসক দলেরই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন তিনি মাওবাদী নেতা আজাদের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছিলেন। আর আজ কিষেণজির মৃত্যুতে রাজ্যের বিরোধী দল নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছেন। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছেন। এনডিএ জমানায় তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজকে বয়কট করেছিল কংগ্রেস। আর আজ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে বয়কট করছে বিজেপি। বিজেপি নেতা যশবন্ত সিন্হা অর্থমন্ত্রী হয়ে যখন বিমা বেসরকারীকরণের হয়ে বিল পেশ করেছিলেন তখন কংগ্রেস তার বিরোধিতা করেছিল। আর আজ যশবন্ত সিন্হা যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, এই সরকার সংসদে কোনও বিলই পাশ করতে পারছে না, তখন প্রণববাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন, বিরোধী দল গঠনাত্মক না হলে সরকার কাজ করতে পারে না।
এই প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপদ একটিই। ক্রমশ সাধারণ মানুষ ভারতের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। নানা মত, নানা পথের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে যেন একদলীয় স্বৈরশাসনই ঢের ভাল, এমন এক নৈরাজ্যবাদী চিন্তাকে আমরা উৎসাহিত করছি না তো? সমাজতন্ত্রী চিনের দৃষ্টান্ত দিয়ে অনেকে আজকাল বলেন, কী হবে আমার রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ে, যদি বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য অর্থনীতি আর প্রশাসনিকতাকে এতটাই মূল্য দিতে হয়?
দুর্ভাগ্য আমাদের, ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা ভোটব্যাঙ্কের তথাকথিত রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। তাঁরা মানুষের এই হতাশার খবর রাখেন না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.