শেষ পর্যন্ত সকল আশঙ্কা সত্য করিয়া মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হিসাবে ঘোষিত হইল ইসলামি মতাবলম্বী দলগুলি। দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোটদাতা ভোট দিয়াছেন এই দল-গোষ্ঠীগুলিকে। বিপরীতে, যে লিবারেল বা প্রগতিশীল দলগুলির উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে কায়রোর তহরির স্কোয়্যারকে কেন্দ্র করিয়া প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফুঁসিয়া উঠিয়াছিল মিশরীয় জনসাধারণ, তাঁহাদের কেবল ১৩.৪ শতাংশ মানুষের ভোট পাইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হইল। এত বড় দেশের প্রতি প্রান্তে এই আশ্চর্য বিপ্লব ছড়াইয়া দিতে যে লিবারেলরা দারুণ ভাবে সফল হইয়াছিলেন, গণতন্ত্রের প্রথম পরীক্ষায় তাঁহারা যেন ধুইয়া-মুছিয়া গেলেন। প্রধান জয় যে লাভ করিবে মুসলিম ব্রাদারহুড-এর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফ জে পি), তাহা খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। গত কয়েক মাসে মিশরের রাজনীতি ও সমাজের হালচালই তাহা বলিয়া দিচ্ছিল। কিন্তু সেই ভোট-ব্যবধান যে এখানে পৌঁছাইবে, খোদ এফ জে পি দলও সম্ভবত তাহা আশা করে নাই। আরও চিন্তার কথা, কট্টর ইসলামি মতবাদ সালাফি-প্রভাবিত আল-নূর দল এই নির্বাচনে ২৪ শতাংশেরও বেশি ভোট পাইয়াছে, অর্থাৎ প্রতি চার জন মিশরীয়ের এক জন মনে করিয়াছেন, চার দশকের কর্তৃত্ববাদী একনায়ক হোসনি মুবারকের পরে দেশের শাসনকার্য অতি-রক্ষণশীল মৌলবাদী পথেই চালনা করা উচিত। মহিলাদের বোরখা পরিধান পরা, সামাজিক ভাবে অন্তরিন করিয়া রাখা, সম্পূর্ণ ইসলামি শিক্ষা ব্যতীত অন্যান্য শিক্ষা নিষিদ্ধ করা, মদ্যপানীয় নিষিদ্ধ করা এবং সমস্ত ক্ষমতার উৎস হিসাবে আল্লাহ্-কে স্বীকার করা: এই সেই এক-চতুর্থাংশের পছন্দসই ভবিষ্যৎ।
মিশরে এ ভাবে ইসলামি কট্টরপন্থার উত্থানের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও প্রচুর। সর্বাপেক্ষা বেশি উদ্বিগ্ন, স্বভাবতই, ইজরায়েল। প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু যদিও জানাইয়াছেন, ইহাতে তাঁহাদের কিছু আসে যায় না, ইতিমধ্যেই কানাঘুষা যে ইজরায়েল-এর সুসমৃদ্ধ প্রতিরক্ষা বাহিনীর পিছনে আরও অনেক বরাদ্দ নিশ্চিত করা হইতে চলিয়াছে। এই কানাঘুষা সত্য হইলে ইরানের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হইতে বাধ্য। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উপরে এই নূতন পরিস্থিতির কী প্রভাব পড়িতে পারে, তাহা এখনও স্পষ্ট নহে। কিন্তু ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উভয়েই নিজ নিজ স্বার্থ লইয়া উদ্বিগ্ন। দীর্ঘকালীন একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটাইয়া দেশে গণতন্ত্র স্থাপনার কাজটিই অতি কঠিন। সেই কঠিন কাজটি শেষ পর্যন্ত সারিয়া ফেলিবার জন্য মিশরীয় জনসাধারণের এক বিরাট অভিনন্দন প্রাপ্য। কিন্তু নির্বাচনের মতো কোনও নূতন সূচনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের কাজটি আরও এক ধাপ কঠিন। সেই কাজটিও যে যথেষ্ট দ্রুত করা গিয়াছে, তাহা আরও বড় সুখবর। ৬৫ শতাংশ ভোটদান সহজ ব্যাপার নহে। অনেক পুরাতন গণতান্ত্রিক দেশও এত ভোটদান অনেক সময়ই নিশ্চিত করিতে পারে না। কিন্তু সেই ভোটের ফল বলিয়া দিতেছে, রাজনৈতিক ভাবে মিশরীয়রা যত দূরেই যান না কেন, সামাজিক প্রগতি এখনও অনেক পথ। এখন নূতন গণতান্ত্রিক সরকার কট্টরপন্থী প্রভাব হইতে নিজেকে কতখানি মুক্ত রাখিতে পারিবে, তাহাই দেখিবার। |