গুরুর জন্মদিনে প্রিয়তম শিষ্যের শ্রদ্ধার্ঘ
স্যরের কয়েকটা চড়থাপ্পড় আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে
মস্তে স্যর।
রমাকান্ত আচরেকর স্যর-কে আমরা এ ভাবেই অভিবাদন জানাতাম। শনিবার যাঁর ৭৯তম জন্মদিন গেল। আচরেকর স্যর-কে নিয়ে আমি যতই বলি না কেন, মনে হয় আরও কিছু বাকি থেকে গেল। মনে আছে, ১৯৮৫-তে যখন আমার দাদা অজিত আমাকে স্যরের কাছে নিয়ে গেল, ওঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, আমার বয়স খুবই কম। ছ’মাস অথবা বছরখানেক বাদে আমি তাঁর নেটে ঢুকতে পারি।
আমার খেলা দাদা দেখেছিল। তাই ও স্যর-কে অনুরোধ করে, অন্তত এক সপ্তাহ আমাকে দেখার জন্য। দাদা স্যর-কে অনুরোধ করেছিল, নেটের পিছনে না দাঁড়িয়ে অন্য জায়গা থেকে আমার খেলা দেখতে। আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেও কিন্তু স্যর সে দিন আমার উপর চোখ রেখেছিলেন।
সপ্তাহখানেক পর উনি আমাকে সামার ক্যাম্পে রাখবেন বলে ঠিক করেন। আর মাস দেড়েক পর উনি আমার স্কুল পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেন। নিয়ে আসেন সারদাশ্রমে, যেখানে উনি কোচ ছিলেন। আর ওখান থেকেই আমার ক্রিকেটজীবনের শুরু।
দাদা আর স্যরের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভাল ছিল। আমাকে নিয়ে ওরা প্রচুর আলোচনা করতেন। স্কুটারের পিছনে বসিয়ে আচরেকর স্যর আমাকে ম্যাচ খেলাতে নিয়ে যেতেন। ভাল খেললে স্কুটার দাঁড় করিয়ে আমাকে ভেলপুরি, পানিপুরি, বড়া পাও খাওয়াতেন। মানুষ হিসেবেও স্যর বিরাট উঁচু মনের। যদি দেখতেন কোনও ছাত্র ক্রিকেটার মাসিক বেতন দিতে পারছে না, কোনও দিন স্যরকে দেখিনি সেটা নিয়ে কিছু বলতে। উল্টে স্যর ওই প্লেয়ারের জলখাবারের খরচটাও দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
উনি প্রচুর ম্যাচ এমন ভাবে দেখতেন যাতে ওঁর উপস্থিতি কেউ বুঝতে না পারে। গাছের পিছনে লুকিয়ে উনি ম্যাচ দেখতে-দেখতে নোট নিতেন। তার পর ম্যাচ শেষ হলে বসতেন ময়নাতদন্তে। কয়েক জন ছাত্রকে আবার সেই নোটগুলো পড়তে হত। ওই সময়-ই বোঝা যেত স্যর-কে সারা দিন না দেখা গেলে কী হবে, উনি পুরো ম্যাচটাই দেখেছেন। খুব তুচ্ছ জিনিসও ওঁকে টুকে রাখতে দেখেছি।
যতটা আমরা ওঁকে ভালবাসতাম, ওঁকে নিয়ে মজা করতাম, ঠিক ততটাই ভয়ও পেতাম। যখন উনি রেগে যেতেন, কাউকে ছাড়তেন না। আমিও কয়েক বার চড়-থাপ্পড় খেয়েছি স্যরের কাছে। ভুল করার জন্য। কিন্তু ওই মুহূর্তগুলোই আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতাম যে, স্যর যা-ই করুন না কেন, আমাদের ভালর জন্যই করছেন।
উনি যা-যা বলতেন আমরা সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতাম। উনি আমাদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, কেন খেলাটাকে সম্মান করা জরুরি। উনি বলতেন, কেউ যদি কোনও মুহূর্তে নিজেকে ক্রিকেটের থেকেও বেশি কিছু ভেবে ফেলে, ক্রিকেট তাঁকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেবে। বলতেন, ব্যক্তির চেয়ে খেলাটা অনেক বড়। এই শিক্ষাগুলো সারা জীবন মেনে এসেছি।
স্যরের জীবনটা খুব সহজ ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হালফিলে আবার শরীর ভুগিয়েছে। কিন্তু জাত স্পোর্টসম্যানের মতো ওঁকে সমস্ত রকম সমস্যার সঙ্গে যুঝতে দেখেছি। শারীরিক ভাবে যতটা সক্ষম ছিলেন, মানসিক ভাবে এখনও ঠিক ততটাই কঠিন। কখনও ক্রিকেটের প্রতি টান কমতে দেখিনি। ‘স্ট্রোক’ হওয়ার পরেও উনি সব সময় চেষ্টা করেছেন এক বার শিবাজি পার্কে যেতে। একটা ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা প্র্যাক্টিস সেশন দেখতে। এতে আমার অবাক লাগে না। জানি, আমার স্যর কতটা শক্তপোক্ত। যখন আমাদের দেখা হয়, বেশির ভাগ কথা আমি-ই বলি। কখনও আমার পরবর্তী সিরিজ নিয়ে। কখনও এখনকার ক্রিকেটারদের নিয়ে। কিন্তু বেশি কথা হয় পুরনো দিনগুলো নিয়ে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ বা ম্যাচের আগে আমি স্যরের সঙ্গে নিয়ম করে দেখা করি।
কিছু দিন আগে উনি আমার নতুন বাড়িতেও এসেছেন। আমার কাছে যেটা বিরল আনন্দের মুহূর্ত। স্যর বাড়িতে আসায় যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম বলে বোঝানো যাবে না। বহু বছর আগে উনি আমার ‘সাহিত্য সহবাস’-এর বাড়িতে এক বার এসেছিলেন। তখন স্কুলে পড়তাম। স্যর-কে বাড়িতে আনা বিরাট ব্যাপার ছিল। মনে আছে উনি বলতেন, ‘বড় রান করলে তবেই আমাকে ডাকবে, নইলে তোমার বাড়িতে আমি আসব না।’ স্কুল পর্যায়ে প্রথম সেঞ্চুরিটা করেই আমি স্যর-কে তাই বাড়ি আসার নেমন্তন্ন করেছিলাম।
শহরে থেকে স্যর-কে ওঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো, ব্যাপারটা ভাবলেই দুর্দান্ত লাগছে। আমরা যখন নিজেদের জন্মদিনে নেট সেশনে নামতাম, কোনও স্পেশ্যাল ব্যাপার থাকত না আমাদের জন্য। উল্টে বেশি করে খাটানো হত। বেশ কয়েকটা নেট সেশনের পর স্যর আমাদের কিছু টাকা দিতেন বড়া পাও খাওয়ার জন্য। শুধু জন্মদিনেই নয়, সাধারণ দিনেও। আজকের দিনটা স্যর এবং আমাদের জন্য আলাদা। দুর্দান্ত একটা ইনিংস উনি খেলেছেন, এবং আশা করব উনি আরও এগিয়ে যাবেন।
ওয়েল প্লেড, স্যর!
নমস্তে স্যর!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.