পরমাণু চুক্তির সময় যা পেরেছিলেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে তা পারলেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন, নীতিগত এই সিদ্ধান্ত বলবৎ করার প্রশ্নে কংগ্রেস অনড় থাকুক। তাতে আখেরে দলের ভালই হবে। কিন্তু এক দিকে শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আপত্তি, অন্য দিকে এখনই ভোট হওয়ার সম্ভাবনা ঘিরে দলীয় সাংসদদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা এই জোড়া চাপে ‘আপাতত’ পিছিয়ে এল কংগ্রেস।
আজ কলকাতায় গিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার পরেই সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বলেন, “প্রণববাবু আশ্বাস দিয়েছেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবে কেন্দ্র। ভবিষ্যতে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সর্বসম্মতি গড়ে তবেই পরবর্তী পদক্ষেপ করবে।” এ বিষয়ে প্রণববাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, “এখন সংসদ চলছে। যা বলার সেখানেই বলব।” সংসদের পরবর্তী অধিবেশন বসবে বুধবার। সে দিনই খুচরো ব্যবসায় ন্যূনতম ৫১ শতাংশ বিদেশি লগ্নির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার কথা সরকার ঘোষণা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বেশ কিছু দিন ‘অধরা’ থাকার পরে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় মমতার। কিন্তু মনমোহনের যুক্তিতে মন গলেনি মুখ্যমন্ত্রীর। সূত্রের খবর, তার পরেই সন্ধ্যায় কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার বিষয়টি স্থির হয়।
|
কিন্তু কংগ্রেস সূত্রে এ-ও বলা হচ্ছে যে, শুধুমাত্র মমতার আপত্তির জন্যই যে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হল এমনটা নয়। দলীয় সাংসদদের একটা অংশের আপত্তিও অনেকটাই দায়ী। তাঁরা মনে করছেন, ২০০৮ সালের জুলাইয়ে পরমাণু চুক্তির সময় যে পরিস্থিতি ছিল, এখন তা নেই। এক বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, তখন কৃষি ঋণ মকুব, একশো দিনের প্রকল্প ইত্যাদি জনমুখী প্রকল্পের জন্য প্রথম ইউপিএ সরকারের ভাবমূর্তি ছিল অনেকটাই উজ্জ্বল। ভোট হতে বাকি ছিল আর মাত্র এক বছর। ফলে ‘এখনই ভোট হলে হবে’ এমন ঝুঁকি নেওয়া সহজ ছিল। কিন্তু এখন কমনওয়েল্থ থেকে টু-জি একের পর এক দুর্নীতিতে কোণঠাসা সরকার। দুর্নীতির প্রশ্নে সদ্য দেশব্যাপী রথযাত্রায় ভাল সাড়া পেয়েছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। তার উপর ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন অণ্ণা হজারে। তা ছাড়া, ভোটের নির্ধারিত সময় আড়াই বছর দূরে। এখন যদি সরকার পড়ে গিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচন হয়, তা হলে ফের ক্ষমতায় আসা যাবে কি না, সেটাই সংশয়ের।
প্রশ্ন হল, তা হলে দু’দিন আগেই কেন এত কড়া অবস্থান নিয়েছিল কংগ্রেস? দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এই সঙ্কটকে যে সুযোগে পরিণত করা সম্ভব, সেটা কংগ্রেস সভানেত্রীকে বোঝাতে পেরেছিলেন মনমোহন। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির অর্থনৈতিক সুফলের কথা বুঝিয়েছিলেন প্রণববাবুও। তিনি সনিয়াকে বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এতটাই অনড় যে, ইস্তফা পর্যন্ত দিতে রাজি। সেই অবস্থায় দলকে দৃঢ় ভাবে মনমোহনের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন সভানেত্রী। কিন্তু দেখা যায়, মমতার মতো শরিক এবং মুলায়ম, মায়াবতীর মতো সহযোগীরা পাশে না থাকলে মুলতুবি প্রস্তাবের গাঁট পেরিয়ে যাওয়াটা নিশ্চিত হচ্ছে না। আর যে ভোটের জুজু দেখিয়ে শরিক, সহযোগী ও বিরোধীদের কাবু করার চেষ্টা চলছে, তাতে ভয় পাচ্ছেন কংগ্রেসেরই অনেক সাংসদ। শেষ পর্যন্ত তাই এক কদম এগিয়েও দু’কদম পিছিয়ে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেন সনিয়া।
কাল কোর কমিটির বৈঠকে স্থির হয়েছিল, আজ কলকাতায় গিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলবেন প্রণববাবু। তিনি নিজে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেন। তবে আজ কলকাতায় গিয়ে হাসপাতালে মমতার অসুস্থ মাকে দেখে এলেও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রণববাবুর দেখা হয়নি। ফোনে অবশ্য কথা হয় তিন বার। আজও প্রণবাবুর যুক্তি মানেননি মমতা। কংগ্রেসের হিসেব হল, তৃণমূল যদি মুলতুবি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিয়ে অনুপস্থিতও থাকে, তা হলেও সরকারের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে মমতা আজও বিরোধিতার সিদ্ধান্তে অনড়ই থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যত স্থির হয়ে যায় খুচরো ব্যবসা নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ।
সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, সম্ভবত মঙ্গলবারের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে দেশ জুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণে আগের সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখা হল। এ ব্যাপারে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ করবে। কেন্দ্রের এক শীর্ষ সারির নেতার বক্তব্য, সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখার জন্য ফের মন্ত্রিসভার অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তা না করলে বিরোধীরা সংসদ অচল করে রাখবে। তাই সংসদ চালানোর স্বার্থেই তা করা হল।
ঘটনা হল, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত নিয়ে গোড়া থেকেই অনেক প্রশ্ন রয়েছে কংগ্রেসের মধ্যে। মন্ত্রিসভার মধ্যেই জয়রাম রমেশ, এ কে অ্যান্টনির মতো দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ নেতারা আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এটা সঠিক সময় নয়। দলের অনেকেই বলছেন, যে সিদ্ধান্ত সংসদে অনুমোদন করানোর দরকার নেই, সংসদ চলাকালীন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন বিপদ ডেকে আনল সরকার।
তা ছাড়া, দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ রাজ্যই খুচরো ব্যবসাকে বিদেশি পুঁজির সামনে খুলে দেওয়ার বিরোধী। যার মধ্যে কংগ্রেস-শাসিত কেরলও রয়েছে। এখন সরকারি সিদ্ধান্ত হল, কোনও রাজ্য না চাইলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে না। তা হলে শুধু কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বলবৎ করার জন্য তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও দরকার ছিল কি না, এই প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া, গোটা বিষয় নিয়ে রাহুল গাঁধীর অবস্থানও স্পষ্ট নয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় সিংহ, প্রবীণ অ্যারন, জ্যোতি মির্ধার মতো সাংসদরা প্রকাশ্যেই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন।
তবে কংগ্রেসের তরফে আজ এই দাবিই করা হয়েছে যে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসা হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হচ্ছে মাত্র। শরিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলীয় মুখপাত্র জনার্দন দ্বিবেদীর এই বক্তব্যের পরে দলের এক নেতার মন্তব্য, এটা এক দিকে মুখরক্ষা, অন্য দিকে বিরোধীদের কৃতিত্ব নিতে না দেওয়ার কৌশল। কিন্তু গোটা ঘটনায় সরকার তথা দলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেই গেল। যা মেরামত করাই এখন সনিয়া-মনমোহনের প্রথম চ্যালেঞ্জ।
|