রাজারহাটে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
‘নিষ্ফলা’ বৈঠকে কোণঠাসা পূর্ণেন্দু, তবু ঐক্যবদ্ধ ছবিই দেখাচ্ছে তৃণমূল
কেষ্টপুর ও রাজারহাটের ঘটনা নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের মধ্যে যে আড়াআড়ি ‘বিভাজন’ তৈরি হয়েছিল, তার মীমাংসায় শনিবারের বৈঠক কার্যত ‘নিষ্ফলাই’ রইল। প্রকাশ্যে অবশ্য দলের তরফে ‘ঐক্যবদ্ধ’ ছবিই তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত, দলের ঐক্যবদ্ধ চেহারা তুলে ধরতে আগামী ১৩ ডিসেম্বর রাজারহাটে একটি ‘রাজনৈতিক সভা’রও আয়োজন করা হচ্ছে। তার আগেই অবশ্য ৯ তারিখ রাজারহাটে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সরকারি কর্মসূচি রয়েছে। সেখানেও দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের ‘একজোট’ করার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে এ দিনের বৈঠক কিন্তু ‘উত্তপ্ত’ই ছিল। বস্তুত, বৈঠকে নিজেদের মধ্যে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন দলের রাজ্য সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত বক্সী এবং দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেন। একটা সময়ে সেই বিবাদ থামাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় রাজ্যের আর এক মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে। দলের একাধিক মন্ত্রী (রাজ্য ও কেন্দ্রের), বিধায়ক এবং নেতা সরাসরি মুখ খোলেন। একাধিক বিষয়ে পূর্ণেন্দুবাবুর কাছে সরাসরি কৈফিয়তও চাওয়া হয়। তিনি তাঁর মতো করে ‘ব্যাখ্যা’ও দেন।
বৈঠক শেষে ঠিক হয়, দলের নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া এবং সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলা থেকে বিরত থাকবেন। বৈঠকে উপস্থিত দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় পরে বলেন, “কেষ্টপুর ও রাজারহাট-কাণ্ডে কিছু মানুষ পূর্ণেন্দু বসু ও দোলা সেনের নাম জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, পূর্ণেন্দু ও দোলা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তৃণমূলকে হেনস্থা করার জন্য এমন দুরভিসন্ধি করা হচ্ছে।” একই কথা মুকুলবাবু বলেছিলেন গত বৃহস্পতিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘরে মুকুলবাবু, পূর্ণেন্দুবাবু এবং রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে নিয়ে বৈঠক করার পরেও। যা থেকে দলের একাংশ মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন না, দলের অন্দরের বিভাজন এ ভাবে প্রকাশ্যে আসুক। মমতা সে দিনই নির্দেশ দিয়েছিলেন, দলের কোনও ‘পরিচিত মুখ’ রাজারহাট এলাকায় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সিন্ডিকেটে জড়িত থাকলে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেই পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাঁর দলে থাকা চলবে না। এ দিনের বৈঠকেও মুকুলবাবু একই কথা বলেন। বৈঠকে নেতাদের একাংশ সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, দলের অনেক নেতাই ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের কাছে কান্নায় ভেঙে
পড়েছেন স্বপন-খুনে ধৃত পার্থ সরকারের স্ত্রী। ছবি: আর্যভট্ট খান
জেলার সাংসদ, বিধায়ক ও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে তিন ঘণ্টারও বেশি বৈঠক চলে এ দিন।
প্রথম দিকে আলোচনা সাধারণ ভাবে হতে থাকলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ‘উত্তপ্ত’ হতে শুরু করে। বিশেষত, যখন স্বপন-হত্যার ঘটনায় রাজারহাটের যুব তৃণমূল সভাপতি পার্থ সরকারকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ আসে। ঘটনাচক্রে, পার্থবাবুকে গ্রেফতারের ঘটনায় শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দুবাবু দলে যথেষ্ট ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েছেন। বৈঠকেও তার প্রমাণ মিলেছে। তবে বৈঠকে উপস্থিত দলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “নির্দিষ্ট করে কেউ পূর্ণেন্দুবাবুকে আক্রমণ করেননি। যে যাঁর নিজের বক্তব্য বলেছেন। ঘটনাচক্রে তা পূর্ণেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ হিসেবে বেরিয়ে এসেছে।” পার্থবাবুর গ্রেফতারির পর জেলার শীর্ষনেতৃত্বের অধিকাংশই ওই যুবনেতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ দিন সকালে দলের মন্ত্রী তথা সাংসদ সৌগত রায় এবং কাকলি ঘোষদস্তিদার পার্থবাবুর পরিবারের সঙ্গে দেখাও করতে গিয়েছিলেন (কাকলিদেবীও বৈঠকে পূর্ণেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন।) পার্থবাবুর পরিবারের তরফে সরাসরি অভিযোগ করা হয়েছে, পূর্ণেন্দুবাবুই তাঁকে ‘ফাঁসিয়েছেন’। সেই প্রসঙ্গও বৈঠকে ওঠে বলে দলীয় সূত্রের খবর।
ধৃত পার্থবাবুর বিরুদ্ধে দল কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। বৈঠকের পর মুকুলবাবু বলেন, “প্রশাসনিক ভাবে তদন্তে যা প্রমাণিত হবে, সেই মতোই প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। দল কোনও ব্যবস্থা নেবে না।” বৈঠকে দলের এক বিধায়ক বলেন, যা হচ্ছে, তা দলের ভাবমূর্তির পক্ষে ভাল নয়। সরকার মনে করলে ‘প্রকৃত দোষী’কে খুঁজে বার করতে পারে। এই মুহূর্তে সেটাই করা উচিত।
পার্থবাবুর সূত্রেই বৈঠকে বাদানুবাদ শুরু হয়। সৌগতবাবু সরাসরিই বলেন, পার্থবাবুর মতো নেতারাই তাঁকে ‘নির্বাচনী বৈতরণী’ পার করান। স্বপনবাবুও তাঁর হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন। পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, তাঁর নামে যা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। গত কয়েক দিন ধরে দলের একাধিক নেতা তাঁর নামে দলের অন্দরে কটূক্তি করলেও তিনি কিন্তু পাল্টা কিছু বলেননি বা বিবৃতি দেননি।
সিপিএম পরিচালিত রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই মঞ্চে কেন পূর্ণেন্দুবাবুকে একাধিক বার দেখা গিয়েছে, তা নিয়েও বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হয়। পূর্ণেন্দুবাবু জানান, ওই মঞ্চ আদৌ ‘রাজনৈতিক’ ছিল না। দু’টিই ছিল সামাজিক অনুষ্ঠান। এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোয় তিনি গিয়েছিলেন। যার জবাবে সৌগতবাবু বলেন, তিনিও এলাকার সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে এমন ‘সামাজিক’ আমন্ত্রণ একাধিক বার পেয়েছেন। কিন্তু সিপিএমের মঞ্চে যাননি!
পূর্ণেন্দুবাবু অবশ্য তখন আর বাক্যব্যয় করেননি। তবে মন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনায় দলের ‘পর্যবেক্ষক’ জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান, রাজারহাট-গোপালপুর এলাকায় এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি কোনও না কোনও ভাবে ওই পুরসভার চেয়ারম্যান তাপসবাবুর ‘দাক্ষিণ্যধন্য’ নন।
ঠিক হয়, দলের ‘ঐক্যবদ্ধ’ ছবি তুলে ধরতে ৯ তারিখে মুখ্যমন্ত্রীর হজ-হাউস সংক্রান্ত অনুষ্ঠানকে ‘ব্যবহার’ করা হবে। তখনই দোলা অভিমত প্রকাশ করেন, শনিবারই তো ৩ তারিখ হয়ে গেল। এখনও ওই সভার পাঁচ দিন বাকি। এই ক’দিনে তো সংবাদমাধ্যমে রাজারহাট-কাণ্ড নিয়ে আরও লেখালেখি হবে। ফলে ৯ তারিখের আগে কি সভা করা যায় না? মুকুলবাবু বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সভার আগে দলীয় সভা করা ঠিক হবে না। আর রাজ্য সভাপতি সুব্রতবাবু বলেন, সভা কবে-কোথায়-কখন হবে, তা দলের শীর্ষনেতারা ঠিক করবেন। সংবাদমাধ্যম কী লিখল, তা দিয়ে সেই কর্মসূচি ঠিক হবে না। সংবাদমাধ্যম তাদের কাজ করুক। তাঁরা দলের কাজ করবেন। খবরের কাগজে কী লেখা হল, তা নিয়ে মাথা ঘামালে দল করা চলে না। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানিয়েছেন, কিছুটা ‘উত্তেজিত’ হয়েই সুব্রতবাবু দোলাকে বলেন, দল দলের মতোই চলবে। তার একটা নিয়মনীতি আছে। সে বিষয়ে দলের শীর্ষনেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন।
তখনই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন পূর্ণেন্দুবাবু নিজেই। তিনি দোলাকে লক্ষ্য করে বলেন, তাঁকে কারও ‘রক্ষা’ করার প্রয়োজন নেই। তিনি (পূর্ণেন্দুবাবু) নিজেই নিজেকে ‘রক্ষা’ করতে সক্ষম।
মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই ইট-বালি সরবরাহের সিন্ডিকেট করা থেকে ‘বিরত’ থাকার নির্দেশের পাশাপাশি এ দিন তৃণমূল নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জেলার ‘ভেড়ি রাজনীতির’ সঙ্গেও দলের কেউ জড়িত থাকতে পারবেন না। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ভেড়ি সংক্রান্ত ব্যবসায় দলের নেতারা হস্তক্ষেপ করছেন, এমন একাধিক অভিযোগ পেয়েই এ দিন ওই ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। একই সঙ্গে শাসনের মতো এলাকায় দলের সাংগঠনিক শক্তি আরও বাড়ানোর নির্দেশও দেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.