ধর্ষণের শিকার তিনি। অথচ ব্যাভিচারের দায়ে ইতিমধ্যেই দু’বছর কেটে গিয়েছে জেলে। সেখানে একটি মেয়ের জন্মও দিয়েছেন তিনি। অবশেষে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পড়ে ‘ক্ষমা’ পেলেন গুলনাজ। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই গত কাল তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
কিন্তু ঠিক কী ‘অপরাধে’ তাঁর এই কারাবাস? বছর দুই আগে দূর সম্পর্কিত বোনের স্বামী ধর্ষণ করেছিল গুলনাজকে। সেই সম্পর্কে অভিযোগ জানান তিনি। আর সেই ‘অপরাধেই’ কারাদণ্ড হয় গুলনাজের। কারণ, রক্ষণশীল আফগান সমাজের চোখে গুলনাজ ধর্ষিতা নন। বরং এক বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ হওয়ায় ব্যাভিচারের দায়ে প্রথমে ১২ বছরের ও পরে সাজা কমে ৩ বছরের জেল হয় তাঁর।
গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের অ্যার্টনি জেনারেলের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, ব্যাভিচারের অভিযোগ থেকে গুলনাজকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে দেরি করেন। তাই কিছু সময় তাঁকে সাজা ভোগ করতেই হবে। জীবনহানির আশঙ্কায় গুলনাজ ধর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ জানাতে পারেননি।
কারজাইয়ের গত কালের আদেশের আগে আইনমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ গালিব গুলনাজকে নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। তার ভিত্তিতে কারজাইয়ের নের্তৃত্বে গঠিত একটি কমিটি গুলনাজের জন্য ‘ক্ষমা’ মঞ্জুর করে। |
গুলনাজের মুক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে খবর রটে যে, ধষর্ককে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পরেই এই মুক্তি। কিন্তু কারজাইয়ের মুখপাত্র জানান, এ রকম কোনও শর্তে গুলনাজকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। গুলনাজ নিজেও জানিয়েছেন, ধর্ষককে নয়, বরং কোনও শিক্ষিত মানুষকে তিনি বিয়ে করতে চান। আর যদি নিজের মেয়ের জন্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করতেই হয়, সে ক্ষেত্রে উপজাতি প্রথা মেনে তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ওই ধর্ষকের বোনের বিয়ে দিতে হবে। তবেই একমাত্র তিনি নিরাপদে থাকবেন। গুলনাজকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা মার্কিন আইনজীবী কিম্বারলে মটলে অবশ্য জানিয়েছেন, মুক্তির পরে গুলনাজকে একটি গোপন সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে যাবেন তিনি।
রক্ষণশীল সমাজের ঘেরাটোপ পেরিয়ে কী ভাবে প্রকাশ পেল গুলনাজের কাহিনি?
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্দেশে তৈরি ‘ইন-জাস্টিস: দ্য স্টোরি অফ আফগান উইমেন ইন জেল’ নামে একটি তথ্যচিত্রে গুলনাজের কথা আন্তর্জাতিক দুনিয়া জানতে পারে। ক্লেমেনটাইন মালপাসের তৈরি ওই তথ্যচিত্রে গুলনাজ ছাড়াও আরও দুই নির্যাতিত মহিলার কথা বলা হয়। কিন্তু তথ্যচিত্রটি তৈরি হওয়ার পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নই সেটির মুক্তি আটকে দেয়। ইউনিয়নের যুক্তি ছিল, তথ্যচিত্রটি মুক্তি পেলে ওই মহিলাদের জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। আফগানিস্তানে ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও জানান, এই তথ্যচিত্র তৈরিতে ওই মহিলারা লিখিত সম্মতি দেননি। কিন্তু নির্দেশকের সমর্থকদের ও কিছু মানবাধিকার সংগঠনের দাবি ছিল, আফগান সরকার যাতে না চটে যায়, সে কারণেই এই তথ্যচিত্রের মুক্তি আটকে দেওয়া হয়েছে।
তথ্যচিত্রের মুক্তি আটকে দেওয়ার ব্যাপারটি মানবাধিকার সংগঠনগুলির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে যায়। গুলনাজের মুক্তির জন্য আবেদন করে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হয়। প্রায় ৬ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করার পর তা স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
আন্দোলনের ফল তো মিলল। মুক্তি পেলেন গুলনাজ। কিন্তু এর পর কী? সমাজের রক্ষণশীলতার চাপে ধর্ষককে বিয়ে করে সন্তানকে বৈধতা, নাকি এক নতুন জীবন? কী অপেক্ষা করে আছে গুলনাজের জন্য? উত্তরের অপেক্ষায় সকলে। |