পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ‘স্বপ্ন’ নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির পিছনে ছুটে তাঁর আশ্বাস পেয়েছিল বছর চোদ্দোর বিক্রম পোড়েল! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের ছ’মাস পরেও পড়াশোনা শেখার বদলে শুধু খেলে-ঘুমিয়ে সময় কাটছে ওই কিশোরের!
দু’মাস রাস্তায় কাটানোর পর গত ২৭ জুন মহাকরণের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল বিক্রম। রাত ন’টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি মহাকরণ ছেড়ে বেরোচ্ছে দেখে সেই গাড়ির পিছনে ‘দিদি’ ‘দিদি’ বলে ছুটতে শুরু করে সে। রোগাপাতলা ছেলের চিৎকার শুনে গাড়ি থামিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন তার কথা। মুখ্যমন্ত্রীকে বিক্রম বলেছিল, “থাকার জায়গা নেই। খেতে পাচ্ছি না। দু’মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। লেখাপড়া করতে চাই। ক্রিকেট খেলতে চাই। আপনি কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন দিদি?”
ছেলেটির কথা শোনামাত্রই কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারদের ডেকে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ওর জন্য এখনই কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।” মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে বিক্রমকে একটি হোমে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি)’। তার বৃত্তান্ত শুনে ঠিক হয়, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন ফর বয়েজে রেখে পড়ানো হবে বিক্রমকে। রহড়ায় তাকে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ কল্যাণ দফতর লিখিত নির্দেশও দেয়। কিন্তু সিডব্লিউসি-র অভিযোগ, তার পর থেকেই শুরু হয় টালবাহানা। বিক্রমকে ভর্তি নিতে মিশনের তরফে ‘গড়িমসি’ শুরু হয় বলেও অভিযোগ কমিটির। যে জন্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এবং তারপর সমাজকল্যাণ দফতরের নির্দেশের পর ছ’মাস কেটে যাওয়ার পরেও বিক্রমের ঠিকানা ট্যাংরার পটারি রোডের একটি হোম। মানসিক ভাবে অসুস্থ, মূক-বধির অনাথ বাচ্চাদের সঙ্গেই সেখানে দিন কাটছে তার। হোমে বসেই বিক্রম বলছে, “রহড়া স্কুলে তো ভর্তি নেবে না বলেছে! তবে ক্রিকেট খেলতে পারব, এমন যে কোনও স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেই হবে। এখানে ভাল লাগে না থাকতে। সিডব্লিউসি-র আন্টিরা ঠিক কিছু ব্যবস্থা করবে জানি।”
বিক্রমকে ভর্তি নিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের গড়িমসির কথা জানিয়ে সিডব্লিউসি-র প্রাক্তন চেয়ারপার্সন (বিক্রমকে রহড়ায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত তাঁর নেতৃত্বেই হয়েছিল) অমিতা সেনের অভিযোগ, “সরকারি নির্দেশ বেরিয়ে গিয়েছে। অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ আজ-কাল করে ঘোরাচ্ছেন। একবার ওঁরা জানালেন, নভেম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হবে বিক্রমের। কিন্তু তার পরে আর যোগাযোগই করছেন না! ওকে ভর্তি না নিলে স্পষ্ট জানিয়ে দিন। সে ক্ষেত্রে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করা হবে।” অমিতাদেবীর আফশোস, “অস্থায়ী ভাবে যে হোমে এখন বিক্রম রয়েছে, সেখানে ও তো কোনও পরিবেশই পাচ্ছে না! চনমনে ছেলেটা চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে!” যে হোমে বিক্রম রয়েছে, সেখানকার এক আধিকারিকও বলছেন, “শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি ওঁরা ভর্তি নেবেন না বলেছিলেন। এ মাসে আমরা ফের যোগাযোগ করায় জানালেন, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি নেওয়া হবে। অথচ বিক্রম সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। শুনে ওঁরা জানালেন, ভর্তি হতে হলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে। না হলে এখন ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়।’’
অভিযোগ অবশ্য স্বীকার করে নিয়েই রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের ভর্তি বিভাগের এক কর্তা বলেছেন, “শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি এবং চতুর্থ শ্রেণির উপরের ছাত্রকে ভর্তি নেওয়া যে সম্ভব নয়, তা বারেবারে সমাজকল্যাণ দফতরকে জানানো হয়েছে। তবে ছেলেটির নাম মনে রাখলাম। এ বার এলে চেষ্টা করব ওকে ভর্তি নেওয়ার।”
ততদিন পর্যন্ত পটারি রোডে মানসিক ভাবে অসুস্থ, মূক-বধির-অনাথ শিশুদের সঙ্গেই কাটবে বিক্রমের কৈশোর। |